গবাদি পশুকে আত্মরক্ষা শেখানোর কৌশল মিশে পুরুলিয়ার ‘কাড়াখুঁটা’য়

চতুর্দিকে বেজে চলেছে ধামসা, মাদল, ঢোল। গাওয়া হচ্ছে অহিরা গীত। মাঠের মধ্যে পোঁতা আছে শাল কাঠের একটা খুঁটি। সেখানে বাঁধা রয়েছে একটি গরু, বলদ কিংবা মহিষ-জাতীয় গবাদি পশুকে। বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করে তোলা হচ্ছে তাদের। আর মুখের সামনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গবাধি পশুর শুকনো চামড়া। রেগে গিয়ে নিরহ প্রাণীটিও চেহারা নিচ্ছে আক্রমণাত্মক।

ঠিক যেসময় রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় দীপাবলির আনন্দে সবাই মেতে ওঠেন, সেই কার্তিকী অমাবস্যা থেকেই পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পঃ মেদিনীপুরের ভূমিজ, আদিবাসী, কুড়মী, সাঁওতাল, লোধাদের কৃষিভিত্তিক উৎসব ‘বাঁদনা’ শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ঝাড়খণ্ড রাজ্য ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের আদিবাসীরাও মেতে ওঠেন বাঁদনায়। ঠিক এই সময়ই। তবে মূলত আদিবাসী উৎসব হলেও প্রায় সমগ্র পুরুলিয়াতেই পালিত হয় বাঁদনা। আর এই উৎসবেরই একটি অঙ্গ হয়ে গেছে এই প্রথাটি। পরিচিত গরুখুঁটা বা কাড়াখুঁটা নামে।

মূলত, ভাইফোঁটার দিনই পুরুলিয়ায় পালিত হয় গরুখুঁটা বা কাড়াখুঁটা। গরু, মহিষ প্রভৃতি গবাধি পশুদের গায়ে দেওয়া হয় রঙিন ছাপ। করা হয় পুজোও। এরপর নির্বাচন করা হয় তাদের মধ্যে বলিষ্ঠদের। খুঁটিতে বেঁধে পালিত হয় গরুখোঁটার রীতি।

ঘটনার বিবরণ শুনে এই রীতির সঙ্গে অনেকটা স্পেনের বুল-ফাইটিংয়ের সাদৃশ্য পাচ্ছেন নিশ্চয়ই? আর তার সঙ্গেই স্বাভাবিকভাবে চিন্তা-ভাবনা আসার কথা গবাধিপশুর ওপর এও তো একধরণের অত্যাচার। তবে ঠিক তেমন নয় বিষয়টা। এই সংস্কৃতির পিছনে লুকিয়ে রয়েছে এক অন্য কারণ। যে গল্প জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে বহু বছর আগের ছোটনাগপুর মালভূমির প্রান্তবাসীদের কথায়।

অন্যান্য আদিবাসী উৎসবের মতোই গরুখোঁটাও অত্যন্ত প্রাচীন এক উৎসব। যার জন্ম মূলত ছোটনাগপুর মালভূমির জঙ্গল, পাহাড়বেষ্টিত গ্রামগুলোতে। যেখানে শাল-পলাশের ছায়া ঘন হয়ে সন্ধে নামত। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর শিখরভূমিতে তো আর হিংস্র পশুর অভাব ছিল না। রাত হলেই কৃষিজীবি মানুষজনের গোয়ালে হানা দিত বাঘ, ভালুকের মতো শিকারি পশুরা। ফলে প্রায়শই খুঁটিতে বাঁধা অবস্থাতে প্রাণ যেত গবাদি পশুদের। 

আরও পড়ুন
হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই; বাংলার দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলনেই জন্ম পুরুলিয়ার

এমন অতর্কিত আক্রমণ থেকে গবাধি পশুকে বাঁচানোর উপায় খুঁজতেই প্রচলন হয়েছিল গরুখুঁটার। খুঁটিতে বাঁধা অবস্থাতে গৃহপালিত জীবটিকে আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করানোর জন্য উদ্ভব হয়েছিল এই উৎসবের। একটি চামড়ার খণ্ড মুখের সামনে বারবার আন্দোলিত করেই তাই উত্তেজিত করা হয় তাদের। চারপাশে চিৎকার, বাজনা এবং গান। গৃহস্থবাড়িতে হঠাৎ হিংস্র পশুর আক্রমণ হলে ঠিক যে পরিস্থিতি তৈরি হত, অনেকটা অনুরূপ পরিস্থিতি তৈরি করা হয় উৎসবে। উদ্দেশ্য, হঠাৎ আক্রমণে ভীত না হয়ে গৃহপালিত পশুটি প্রতিআক্রমণ করে আত্মরক্ষা করতে পারে। 

আরও পড়ুন
প্রয়াত শবরদের দিনবদলের পথিকৃৎ নন্দলাল শবর, শোকস্তব্ধ পুরুলিয়া

গরু বা মহিষকে উত্তেজিত করার জন্য একসময় ব্যবহৃত খোদ বাঘ বা ভালুকের চামড়া। তবে আজ সেসব দুর্লভ। ফলে গবাধি পশুর শুকনো চামড়া দিয়েই করা হয় সেই কাজ। অত্যাচার নয়, এই রীতির ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে এক স্নেহের পরত। শরৎ শেষে হেমন্তের বিকেলে, বাঁদনার সময়, মানভূম কৃতজ্ঞচিত্তেই বন্দনা করে এই জীবগুলির। যারা কৃষিকাজে, জীবনধারণে এই মানুষগুলোকে বছরভর শ্রম দিয়ে এসেছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য ধামসা-মাদলের রবে, কৃষক কানে হাত দিয়ে সুর ধরেন অহিরার। শেখান আত্মরক্ষার মন্ত্র। “অহিরে... চারিপায়ে দাঁড়হাবি, দুই শিংয়ে মারিবি, বাঘুয়াকে রাখবি ঘলটাঞ...”

পুরুলিয়া তথা মানভূমের সংস্কৃতি, আচার, পরব সবই প্রকৃতি কেন্দ্রিক। বহিরঙ্গের ভিতরে লুকিয়ে আছে পূর্বজদের সেই সরল অন্তঃকরনের কল্যাণকামী মনোভাব, একবুক ভালোবাসা। যা শুধু মানুষকে কেন্দ্র করে নয়, সেই ভালোবাসা ব্যপ্ত হয়েছে জল, জঙ্গল, গজবুরু, টুরগা ঝরনা থেকে শুরু করে নিরীহ গৃহপালিত জীবদের ওপরও...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ধানের জমিতেই শুরু হতে চলেছে মাছচাষ, কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব পুরুলিয়ায়