বিপন্ন নয় গরু, কোন ‘সংরক্ষণ’-এর উদ্দেশ্যে জাতীয় পশু ঘোষণার প্রস্তাব?

গরুকে ভারতের জাতীয় পশু হিসাবে ঘোষণা করা হোক। না, কোনো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন নয়, সম্প্রতি কেন্দ্রকে এই আর্জি জানিয়েছে খোদ এলাহাবাদ হাইকোর্ট। বিচারপতি শেখর কুমার যাদবের এই রায় ঘিরে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। এর আগেও বহুবার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের পরিবর্তে গরুকে জাতীয় পশু করার প্রস্তাব উঠেছে। তবে তা রাজনৈতিক মহল থেকে। এবারেও সেই একই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রভাব দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। যদিও বিচারপতি যাদব তাঁর রায়ে কোথাও বাঘকে জাতীয় পশুর মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেননি। পৃথিবীর অনেক দেশেই একাধিক জাতীয় পশু রয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও তা অসম্ভব নয়।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে অন্য জায়গা থেকে। কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে বহু প্রাচীন কাল থেকেই গবাদি পশু সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। তাই এই দিক থেকে বিচারপতি যাদবের বক্তব্য একেবারেই সঠিক। কিন্তু শুধুমাত্র এইটুকু কারণে কি কোনো পশুকে জাতীয় পশু হিসাবে ঘোষণা করা যায়? এমনটা অবশ্য পৃথিবীর অনেক দেশেই হয়েছে। ইউরোপের বেশ কিছু দেশে জাতীয় পশু হিসাবে কিছু পৌরাণিক কাল্পনিক পশুর উল্লেখও আছে। ইংল্যান্ডের ড্রাগনই তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উদাহরণ। কাল্পনিক হলেও এরা সেইসমস্ত দেশের সংস্কৃতির অংশ। তাই সরাসরি এভাবে উত্তর না খুঁজে আরও কয়েকটা বিষয় খতিয়ে দেখা যাক।

১৯৭২ সালে বাঘকে ভারতের জাতীয় পশু হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়। একইসঙ্গে গড়ে ওঠে একটি সরকারি প্রকল্প, যার নাম ‘প্রোজেক্ট টাইগার’। ভারতের সমস্ত অঞ্চলেই একসময় বাঘের রমরমা ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে যথেচ্ছ শিকার এবং পরবর্তীকালে চোরাশিকারীদের কবলে পড়ে সংখ্যাটা ততদিনে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জাতীয় পশু হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি সরকার এই প্রাণীটির সংরক্ষণের বিষয়েও তৎপর হবে, এটাই ছিল উদ্দেশ্য। এমনকি ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সরকারি পশু হিসাবেও তাদেরই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যাদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।

এবার আসা যাক বিচারপতি যাদবের রায় প্রসঙ্গে। তিনিও উল্লেখ করেছেন, গরুর সংরক্ষণের জন্যই তাকে জাতীয় পশু হিসাবে ঘোষণা করা প্রয়োজন। কিন্তু গরু তো বন্যপ্রাণী নয়। গৃহপালিত পশুর ধারণাও তো একধরণের সংরক্ষণের ধারণার মধ্যেই পড়ে। অবশ্য তারপরেও গৃহপালিত পশুর সংখ্যা কমতে পারে। কিন্তু পরিসংখ্যান যে উলটো কথা বলছে। ১৯৫১ সালে যেখানে সারা দেশে ১৫ কোটির আশেপাশে গরু ছিল, আজকে সেই সংখ্যাটা ২০ কোটি ছাড়িয়েছে। তাহলে কোন বিপন্নতার কথা বলছেন বিচারপতি যাদব? প্রশ্ন থেকে যায়। আর এই প্রশ্নকে উস্কে দিয়ে যায় রায়ের আরও একটি বক্তব্য। সেখানে তিনি বলেছেন, গো-সংরক্ষণকে প্রত্যেক হিন্দুর মৌলিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। যদিও রায়ের শুরুতেই তিনি বলেছেন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেরিয়ে এ-দেশে গরুর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বুঝতে হবে। কিন্তু এইবার এসে পড়ল হিন্দু ধর্মের প্রসঙ্গ। এবং লক্ষণীয় বিষয়, মৌলিক দায়িত্ব নয়, তিনি মৌলিক অধিকার ঘোষণা করার কথা বলেছেন। কিন্তু সেই অধিকার কেমন, তা স্পষ্ট হয় না। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা দেখেছি সারা দেশে অসংখ্য সংখ্যালঘু, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষকে গরুচোর বা গরু পাচারকারী সন্দেহে পিটিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে। এই চেষ্টাকেই কি স্বীকৃতি দিতে চাইছেন বিচারপতি যাদব? প্রশ্নটা আরও জোরালো হয়, কারণ তিনি নিজেই একটি মামলায় এমনই এক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও জামিন দিতে রাজি হনি।

একইভাবে তিনি গরু সংক্রান্ত রায় দিতে গিয়ে বারবার উল্লেখ করেছেন, ভারতীয়রা যখনই নিজেদের সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়েছে তখনই তারা বহিরাগত শাসকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এখানেও সেই একই ইতিহাসের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যে ব্যাখ্যায় ভারতের মুসলমান শাসকদের শুধুই বিদেশি হিসাবে দেখা হয়। অথচ তাঁরাও তো এই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে গিয়েছিলেন। দুটি পৃথক সংস্কৃতি মিলেই তৈরি হয়েছিল ইন্দো-ইসলামিক সংস্কৃতি। সেই ইতিহাসকে বাদ দিয়ে আসলে কি একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থই রক্ষা করতে চাইছেন বিচারপতি? তাঁর রায়ে কেনই বা আফগানিস্তানে তালিবান শাসনের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে? গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা করার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? সম্পূর্ণ রায়ে এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। কিন্তু একটা উত্তর দিয়েছেন বিচারপতি। তা হল, গরুকে জাতীয় পশু হিসাবে ঘোষণা করার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। তিনি বলেছেন, বিজ্ঞানীদের মতে গরু এমন একটা প্রাণী যে প্রশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন ত্যাগ করে। কিছুদিন আগেই উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত এমন একটা মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু কোন বিজ্ঞানীর মতে গরু অক্সিজেন ত্যাগ করে, এই উত্তর জানা যায়নি। হয়তো জানা যাবে কোনোদিন। কিন্তু এভাবে সত্যিই ভারতের সংস্কৃতি বাঁচবে কি?

Powered by Froala Editor

More From Author See More