পদে-পদে নির্ভরশীলতা, চিনা দ্রব্য বয়কট কি আদৌ সম্ভব ভারতের পক্ষে?

চিনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো, চিনা পণ্য বর্জনের ডাক নতুন ঘটনা নয়। শেষ কয়েক বছরে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে এই দাবি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরে আবারও সেই ঢেউ উঠেছিল। তবে এই আগুনে শেষ ঘৃতাহুতি দিল গালওয়ান উপত্যকার ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষ। সামরিকভাবে জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতির সঙ্গেই চিনকে বাণিজ্যিকভাবে শায়েস্তা করতে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে কেন্দ্রকে। সেইসঙ্গে দেশের নানান প্রান্তে ছড়িয়েছে বিক্ষোভও। বহু জায়গায় পোড়ানো হয়েছে চিনের পণ্য, পতাকা, এমনকি শি জিংপিংয়ের কুশপুত্তলিকাও। কিন্তু এসবের পরও প্রশ্ন থেকেই যায় যে, বাণিজ্যিক বাজারে চিনের ওপর নির্ভরতা কতটা কাটিয়ে ওঠা কতটা সম্ভব ভারতের পক্ষে?

‘গেটঅ্যাওয়ে হাউস’ নামের একটি ভারতীয় সংস্থা সম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালিয়েছে ভারতের বাজারে চিনা বিনিয়োগ এবং প্রভাবের ওপর। খোদ ভারত সরকারের তথ্য, কর্পোরেট মন্ত্রক, বিদেশি বিনিয়োগের পরিসংখ্যান এবং সংবাদ মাধ্যমগুলির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই এই সমীক্ষা। আর এই সমীক্ষার ফলাফলেই উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে তথ্যপ্রযুক্তি, বিনোদন কিংবা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিকাঠামো গঠন। প্রায় সর্বত্রই রয়েছে চিনের একচেটিয়া আধিপত্য। যার ফলে নানান ক্ষেত্রে চিনের বিনিয়োগ ফিরিয়ে দিলেও সার্বিকভাবে চিন-বয়কট কার্যত অসম্ভব দেশের ক্ষেত্রে।

ভারতের মোট আমদানির প্রায় ১৩.৬৯ শতাংশই আসে চিন থেকে। দেশের যে সকল সংস্থাগুলির মূল্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি, তাদের মধ্যে ১৮টির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে চিনা বিনিয়োগ। যার পরিমাণ কম করে হলেও চারশো কোটি মার্কিন ডলার। এই তো গেল বড় ইউনিকর্ন সংস্থার হিসেব। এর বাইরে ছোটো-খাটো সমস্ত ক্ষেত্রেই রয়েছে চিনের আধিপত্য। ই-কমার্স থেকে পরিবহণ, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অ্যাপ্লিকেশন। চিনকে ছেড়ে অন্য বিকল্পের কথা ভাবা বেশ কঠিনই। পাশাপাশি চিনের পুরোপুরি নখদর্পনে ইলেকট্রনিক্স বাজার। শুধুমাত্র মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রেই ৭২ শতাংশ বাজার দখল করে রেখেছে দুই চিনের সংস্থা। শাওমি এবং ওপো। সৌরশক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারত ৯০ শতাংশ নির্ভর চিনের ওপর। এয়ার ইন্ডিয়ার ৭৪৭ বোয়িং-ও সেই চিনেরই তৈরি।

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠার কথা, চিনের এই একাধিপত্যের কারণ কী? পরিসংখ্যান বলছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্যের সহজলভ্যতা এবং স্বল্পমূল্যের কারণে দেশের নাগরিক ঝুঁকছে চিনা পণ্যের দিকে। পাশাপাশি অনেক পণ্যের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারত এখনও পর্যাপ্ত শিল্পই গড়ে তুলতে পারেনি দেশের চাহিদার নিরিখে। সেই পণ্যগুলি চিন বাদে অন্য রাষ্ট্র থেকে আমদানি করতে গেলে বাড়বে খরচ। যা এতটাই ব্যতবহুল যে কেনার ক্ষেত্রে অপারগ হয়ে পড়বে দেশের নাগরিক। যা আরো একটা সঙ্গত কারণ ভারতীয় বাজারে চিনের রাজত্বের।

আরও পড়ুন
ভারত-চিন যুদ্ধ, সেন্সর বোর্ডের কোপে মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’

ডেলহিভারি, মেক-মাই-ট্রিপ, ওলা, ফ্লিপকার্ট, পে-টিএম, জোম্যাটো, স্ন্যাপডিল, ক্যুইকার, স্যুইগি, ওয়ো। এই ধরণের সংস্থাগুলি আজকের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। এই সংস্থাগুলির শিকড় ভারতের মাটিতে হলেও চিনা বিনিয়োগ রয়েছে এর প্রত্যেকটাতেই। যার অর্থমূল্য কোথাও ৫, কোথাও ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। এখন এই সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে কতটা সম্ভব এই বিনিয়োগের পথ হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া? তাতে সম্ভাবনা দেখা দেবে তাদেরও বাজার সংকীর্ণ হয়ে আসার।

আরও পড়ুন
গালওয়ান নদীর গতিপথ পাল্টাতে চাইছে লাল ফৌজ? চিনা বাহিনীর কর্মকাণ্ডে চাঞ্চল্য

কেন্দ্র সরকারও কয়েক বছর আগেই ডাক দিয়েছিল ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র। প্রস্তুতকারক এবং উৎপাদনশীল দেশ হিসাবে বিশ্ববাজারে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই ছিল যার প্রধান লক্ষ্য। তবে পাখির চোখ ছিল দেশের তৈরি সামগ্রী ভারতীয় বাজারে ছড়িয়ে আমদানির ওপরে নির্ভরতা কমানো। কতটা সফল হয়েছে সে উদ্দেশ্য? আদৌ কি সেই পরিকাঠামো তৈরি করতে পেরেছে দেশ? এই প্রশ্নের সামনেই বারবার দাঁড় করাচ্ছে পরিসংখ্যান। বেসরকারি সংস্থাগুলিকে বাদ দিয়েও সরকারি নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রেও রমরমা রয়েছে চিনের। সংঘর্ষের জেরে এই মুহূর্তে নড়ে-চড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিএসএনএলের ফোর-জি আপগ্রেডের ক্ষেত্রে বারণ করা হয়েছে চিনা পণ্য ব্যবহারে। রেলের একটি ৫০০ কোটির প্রকল্প থেকে বাতিল করা হয়েছে চিনের সংস্থার নাম। কিন্তু মোট পরিসংখ্যার বিচারে এই সিদ্ধান্ত সামান্য অংশ বিশেষ। এর নিচেই লুকিয়ে রয়েছে সমুদ্রে ডুবে থাকে হিমবাহের বিপুল আয়তন। 

আরও পড়ুন
দেশজুড়ে যুদ্ধ-পরিস্থিতি, কেমন আছেন ভারতের চিনা মানুষরা?

২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, চিনে রপ্তানির জন্য ভারতের আয় ১.১৭ লক্ষ কোটি টাকা। উল্টোদিকে চিনের আয় এর প্রায় চারগুণ। এই আমদানির পরিমাণ কমিয়ে আনতে গেলে দরকার প্রথমে দেশের পরিকাঠামো গঠন। অন্যথায় দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার উদাহরণ চিনের ২০১২ সালের জাপানি পণ্যের বয়কট। পাশাপাশি লকডাউনের কারণে ভারতীয় উৎপাদক সংস্থাগুলিও এখন অনেকটাই ধীর গতিতে চলছে। সেদিক দিয়ে করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতিকে অনেক আগে হারানোর জন্য পুরোদমে চলছে চিনের কারখানাগুলি। যাদের অনেকাংশে কাচামাল রপ্তানি হয় মূলত ভারত থেকেই। চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেদিক থেকেও দেশের আয় বন্ধ হবে এই মহামারীর আবহে। কাজেই চিনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ সবদিক থেকেই কার্যত অসম্ভব। এখন দেখার দেশের প্রশাসনের পরবর্তী সিদ্ধান্ত কোথায় নিয়ে যায় পরিস্থিতিকে...

আরও পড়ুন
চিন-ভারত সংঘর্ষে শহীদ বাংলার রাজেশ ওরাওঁ, শোকের ছায়া বীরভূমের বাড়িতে

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
চিন-ভারত সংঘর্ষে হত আরও ১৭ ভারতীয় সেনা, বলছে সূত্র

More From Author See More