চিন-ভারত সংঘর্ষে শহীদ বাংলার রাজেশ ওরাওঁ, শোকের ছায়া বীরভূমের বাড়িতে

বীরভূম জেলার মহম্মদবাজারের বেলগড়িয়া গ্রামে সুভাষ ওরাওঁ-এর বাড়ির চেহারাটা বদলেছে কিছুদিন আগেই। মাটির বাড়ি বদলে উঠেছে ইটের দেয়াল। আর সেই সাদামাটা একতলা বাড়িতে চলছিল এক উৎসবের প্রস্তুতি। সারাদিন পরিশ্রম করে যে ছেলেকে বড় করে তুলেছেন সুভাষ বাবু, সেই রাজেশের রোজগারেই সামান্য স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে পরিবার। এবার তাই ছেলের বিয়ের বন্দোবস্ত করতে হয়। 

রাজেশ অবশ্য জানিয়ে দিয়েছিলেন, বোনের পড়াশুনো শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজি নন তিনি। তাছাড়া তাঁর জীবিকাও যে অনিশ্চিত এক জীবনে টেনে নিয়ে গিয়েছে। জম্মু-কাশ্মীর লাদাখ সীমান্তে প্রতিনিয়ত অতন্দ্র সতর্কতার মধ্যে দিন কাটে। রবিবার রবিবার ফোনে কথা হয় পরিবারের সঙ্গে। এই রবিবারও ছেলের ফোনের অপেক্ষায় বসে ছিলেন মা মমতা। কিন্তু ফোন এল না। সোমবারও কোনো ফোন এল না। মঙ্গলবার ফোন এল, তবে ছেলের কাছ থেকে নয়। ফোন এল লে'র সামরিক হাসপাতাল থেকে। জানা গেল, যুদ্ধে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রাজেশ।

শেষবার ফোনে রাজেশ জানিয়েছিলেন, পরিস্থিতি ভালো নয়। আবার কবে ফোন করতে পারবেন, জানেন না। তবে সেই ফোন যে পরিবারের সঙ্গে তাঁর শেষ কথোপকথন, একথা ভাবতে পারেননি রাজেশের মা, বাবা, বোন কেউই। মঙ্গলবার রাজেশের আহত হওয়ার খবর শুনে তাই ভেঙে পড়েছিলেন মা মমতা। সুভাষ বাবু অবশ্য আশা করেছিলেন, রাজেশ আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু শেষরক্ষা আর হল না। কিছুক্ষণ পরেই আবার রাজেশের মৃত্যুসংবাদ বয়ে আনল টেলিফোন। ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষে শহিদ হয়েছেন রাজেশ ওরাওঁ। এই একটা সংবাদ যেন বিদ্যুতের মতো আছড়ে পড়ল একতলা বাড়িটার উপর। ছোট্ট দাওয়ায় বসে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মমতা। রাজেশের শয্যাশায়ী বাবার চোখেও দিশেহারা সমান্তরাল দৃষ্টি। 

২০১৫ সালে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়েই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন রাজেশ। তারপর থেকেই নিয়েছেন হার্ড পোস্টিং। লাদাখ সীমান্তের কঠিন পরিস্থিতিতে একটু একটু করে চলেছে দেশপ্রেমের দিনমজুরি। রাজেশের জীবন্ত দেহ লাদাখের সীমান্ত থেকে আর ফিরল না। তাঁর বিয়ের প্রস্তুতিও থেমে গেল মাঝপথেই। উৎসবের প্রস্তুতি নিতে নিতে কখন যে বিষাদের মধ্যে ডুবে গেলেন, বুঝতেই পারলেন না ছোট্ট পরিবারের চারজন সদস্য। বুধবার সন্ধ্যায় হয়তো তাঁর মরদেহ এসে পৌঁছবে বাড়ির উঠোনে। সেই মৃতদেহ আর কোনো গল্প শোনাবে না। চিন-ভারত সীমান্তের কথা বলবে না। সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষের কথাও বলবে না। কিন্তু সুভাষবাবুর কানে এখনও ভাসছে ছেলের শোনানো সেইসব বর্ণনা। রাজেশ ওরাওঁ লড়াই করে মরেছেন। আর পাঁচটা মানুষের থেকে মৃত্যুর সময়েও আলাদা হয়ে থেকে গেলেন বাংলার এই যুবক। তাঁর পরিবারও তো এক জওয়ানের পরিবার। প্রতিটা যুদ্ধে এমন অসংখ্য রাজেশের মৃত্যুই ভবিতব্য। এভাবেই সন্তানহারা হন অসংখ্য সুভাষ ওরাওঁ। এইসব চোখের জলের সামনে বিশ্বমৈত্রীর বাণীও কেমন নিদারুণ পরিহাসের মতো শোনায়।

আরও পড়ুন
চিন-ভারত সংঘর্ষে হত আরও ১৭ ভারতীয় সেনা, বলছে সূত্র

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
চিন সীমান্তে সংঘর্ষ, নিহত তিন ভারতীয় সেনা; বৈঠকে রাষ্ট্রপ্রধানরা