বাংলা সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো ফ্লপ ‘পাতালঘর’ : অর্জুন গৌরিসারিয়া

অর্জুন গৌরিসারিয়া (১৯৬৪—) পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের উল্লেখযোগ্য উদ্যোক্তা (অন্ত্রপ্রেনর), চলচ্চিত্র নির্মাতা, সম্পাদক এবং শিক্ষক। ১৯৮৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত, তিনি ৫০০-টিরও বেশি বিজ্ঞাপনচিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন। এছাড়াও ফিকশন এবং নন-ফিকশন উভয় ক্ষেত্রেই ১০০০ ঘণ্টার বেশি টেলিভিশন প্রোগ্রামিং করেছেন অর্জুন। অর্জুন সম্পাদিত 'গুলাবি গ্যাং' (২০১৪) এবং 'শাট আপ সোনা' (২০২০) তথ্যচিত্রদুটি ফিল্ম-এডিটিং-এর ক্ষেত্রে জাতীয় পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কার পেয়েছে। হালে জি-৫ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়ার পর ‘শাট-আপ-সোনা’ দেশের চলচ্চিত্র আঙিনায় আলোচনার শিরনামে উঠে এসেছে। এছাড়াও মৈনাক বিশ্বাসের সাথে যুগ্ম-পরিচালনায় তৈরি করা প্রথম ফিচারফিল্ম 'স্থানীয় সংবাদ' (২০১১) নিউইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পেয়েছিল সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার । অর্জুন এবং তার বন্ধুদের হাতে গড়ে ওঠা ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক মোশান পিকচার্স’ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র, টেলিভিশান ও বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। বর্তমানে কলকাতাবাসী অর্জুনকে চলচ্চিত্র বিষয়ক অনলাইন বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখতে এবং কখনও সখনও অন্তরঙ্গ আড্ডায় ক্লাসিকাল গিটার হাতেও দেখা যায়। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে রূপক বর্ধন রায়। আজ শেষ পর্ব।

প্রথম পর্বের পর

রূপক : ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে আপনি ’৮৯ সালে গ্র্যাজুয়েট হলেন। এরপর ২০০৩-এ আমরা ‘পাতালঘর’ পেলাম। তাহলে এই মাঝের ১৪ বছরের কথায় একটু আসি? মানে আমি ব্ল্যাক ম্যাজিক মোশান পিকচার্সের তৈরি হওয়ার সময়টাকে একটু ধরতে চাইছি।

অর্জুন : ’৮৯-তে বেরোনোর পর পর একজন ডকুমেন্টারি ছবির পরিচালক (এফ টি আই-এর এক্স ছাত্র) সস্তায় এডিটর খুঁজছিল, মানে খানিকটা ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টের মতো, আমি ঢুকে পড়লাম। (যদিও পরবর্তীকালে এডিটিং প্রায় ফ্রিই করে দিয়েছিল লোকজন, এখন এডিটররা প্রায় না খেয়েই মরে!) পাশ করার পর ৩-৪ মাস আমি বম্বেতে এডিটিং-এর কাজটাই করি। তারপর কলকাতায় ফিরে আসি। কিছু মাস যাওয়ার পর ধীরে ধীরে কাজ আসতে শুরু করে। ’৯৫ সাল অবধি ফ্রিল্যান্সিং করেছি, আর ’৯৫ সালেই ব্ল্যাক ম্যাজিক মোশান পিকচার্স তৈরি হয়।

আরও পড়ুন
ব্যাকরণের বিবর্তন বন্ধ হলে সেই আর্ট ফর্মেরও মৃত্যু হয়: অর্জুন গৌরিসারিয়া

রূপক : ’৯৫-এর পরের গল্পটাই কি দাদু-নীতি-অর্জুনের গল্প? 

আরও পড়ুন
‘বাবু পেলে ছবি বানাব, এখন লক্ষ্য বিজেপিকে হারানো’, বলছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্জুন

অর্জুন : হ্যাঁ, এই সময়টা ধরতে গেলে আমার মতে ওটা একবার পড়তে হবে। ওই গোটা কম্পাইলেশানে আমি খুব ভালোভাবে এই ব্যাপারটা নিয়ে লিখেছি। আমরা ৪ জন কম্পিটিটার ছিলাম। দাদু একটা অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিতে কাজ করত, আর আমি আর নীতি তখন বিবাহিত। আমাদের দুটো আলাদা আলাদা সোল প্রোপরাইটারশিপের কোম্পানি ছিল। কিন্তু সেই কমপিটিশান আর টিকল না, আমরা একসঙ্গেই কাজ করতে শুরু করলাম। এই গোটা ব্যাপারটা নিয়ে পঁচিশ পর্বের লেখাটা অনেকেই বেশ এনজয় করেছে।

রূপক : আমি আমাদের পাঠকদের জন্য কোম্পানির মোটিভেশানটা একটু বুঝতে চাইছি।

অর্জুন : গোড়াতেই কোম্পানির নাম রাখা হয়েছিল ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক মোশান পিকচার্স লিমিটেড’ (মোশান পিকচার কথাটায় জোর দিলেন), অ্যাড ফিল্ম বানাতে চাওয়া কেউ এইরকম ভারী নাম কখনই রাখে না (হাসি)! আইডিয়াটাই ছিল যে আমরা ফিচার ফিল্ম বানাব। অ্যাডভার্টাইজিং বা ওই জাতীয় কাজ আমরা মূলত টাকা তোলার জন্য করতাম, যাতে নিজেদের ছবি নিজেরা বানাতে পারি। 

সমস্যা হল, উই নেভার লার্ন্ট দি নেসেসারি আর্ট অফ হাউ টু পিচ আ ফিল্ম ফর ফান্ডিং! পর পর ছবিগুলো, যেমন ধর পাতালঘর বা তিন-এক্কে-তিন, কিংবা স্থানীয় সংবাদ, আমরা নিজেদের টাকায় বানিয়েছিলাম। অ্যাড ফিল্ম বানাতাম, কিছু টাকা কামাতাম আর তার পুরোটাই ছবিতে ঢেলে দিতাম। কাজেই একটা কোম্পানি হিসাবে এটাই ব্ল্যাক ম্যাজিকের গল্প। মানে শুধু বাংলায় নয় গোটা দেশে ওইসময়ে গুরুত্বের দিক থেকে ব্ল্যাক ম্যাজিক সেকেন্ড মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট ফার্ম ছিল, কাজেই আমাদের তো ঝোলা ভর্তি টাকা রোজগার করার কথা, আর করেওছিলাম, আমি বলছি না যে করিনি! কিন্তু যেই রোজগার হচ্ছে আমরা ফিল্মে ঢেলে দিচ্ছি। এবার সমস্যা হচ্ছে যেহেতু আমরা ফিল্মের ব্যবসাদার নই, কীভাবে ছবি করে নিজেদের জন্য টাকা জমাতে হবে সেটা আমাদের জানা ছিল না।

যেমন পাতালঘর, ইট কন্টিনিউজ টু বি দা বিগেস্ট ফ্লপ ইন দা হিস্ট্রি অফ বাংলা সিনেমা! কাজেই কতদিন অবধি টাকা রোজগার করে জলে দেওয়া যায়? একটা সময়ের পর আই লস্ট স্টিম!

এটাই মোটামুটি ১৯৯৫-২০১০ এর গল্প।

রূপক : ছবির বাজারের কথা বললে হয়তো আপনি ঠিক, কিন্তু আমাদের মত মানুষদের ক্ষেত্রে পাতালঘর ভীষণ ভালোলাগার একটা ছবি।

অর্জুন : হ্যাঁ আমি সেটা জানি, আমি ডিনাই করছি না। মানে লোকে বলে না, ‘বাঙালি বুঝল না’, তা একেবারেই নয়। বাজারের দিক থেকে ভাবলে দা ফেইলিওর ইজ আওয়ার্স! আমরা ছাড়া যারা যারা পাতালঘরের সঙ্গে যুক্ত ছিল, মানে টেলিভিশান রাইট, এই রাইট, সেই রাইট সকলে টাকা কামিয়েছে। এটা একটা স্পেসিফিক বিজনেস, সেটা আমরা জানতাম না, এখনও জানা নেই। 

রূপক : আপনার ফেসবুকের ব্লগটা তো বাংলা ছবির জগতের একটা বিরাট ইতিহাসকে ধরে রেখেছে, সেটাকে বই হিসাবে বের করার কথা ভেবেছেন?

অর্জুন : (একটু বিরক্ত হন) এটা একটা অদ্ভুত প্রশ্ন। এই কথাটা আবার কেন উঠছে আমি জানি না। লেখাটা শুরু করার সময় আমি ভাবিওনি যে এটা এত লম্বা হবে। একদিন লকডাউনের মধ্যে দুপুরবেলা মাল খেতে খেতে মনে হল লিখি, শুরু করলাম, ইট টার্নড ইন্টু আ ২৫ এপিসোড থিং। আমি তো ওটা ফেসবুকে লিখেছি, পাবলিক স্পেসে? এরপর প্রায় চার-পাঁচজন এই কথাটা আমায় জিজ্ঞেস করেছে, তারপর ফ্রিজ করে গেছে। মানে কারো যদি করার হয়, আমার কাছ থেকে যদি আরো কিছু চাওয়ার থাকে, মানে ধর কাগজপত্র চাইল বা ছবি চাইল, সেগুলো আমাকে খুঁজে বার করতে হবে। পেলে আমি অবশ্যই দেব। লেখাটা বই হিসাবে বেরোলে আমি খুশিই হব, আমার ধারণা এটা থেকে রীতিমতো একটা কফি টেবিল বুক হতে পারে, কিন্তু এখানে তো আমার করার কিছু নেই, তাই না? 

রূপক : আমি এবার একটু আপনার ননফিকশন এডিটিং-এর কাজের ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্নে আসি। গুলাবি গ্যাং তো ২০১২ সালে বেরিয়েছিল, তাই না?

অর্জুন : হ্যাঁ, তারপর ২০১৪ সালে জাতীয় পুরস্কার পায়।

রূপক : এরপর আমরা তনভীর কা সফরনামা পাচ্ছি, এক্কেবারে হালে শাট আপ সোনাও এডিটিং-এ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। মানে ২০১০ সালে ব্ল্যাক ম্যজিকের পর আমরা মূলত ননফিকশন কাজেই আপনাকে দেখতে পাচ্ছি, এই পরিবর্তনটা কি ইচ্ছাকৃত, নাকি যেমন যেমন কাজ এসেছে আপনি সেভাবে কাজ করে গেছে্ন?

অর্জুন : না না এগুলো নিজের মতো করেই ঘটেছে। আমি এডিটিং-এর কাজ খুবই এনজয় করি। মানে একটা ছবি বানানোয় যদি ২০০০০ রকম কাজ থাকে, তাদের মধ্যে এডিটিং-ই আমার প্রথম প্রেম। এডিটিং-এর পর শব্দ বা সাউন্ড। মানে ইন্ডাস্ট্রির প্রায় সমস্ত সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, হাউ এক্সাইটেড আই অ্যাম অ্যাবাউট সাউন্ড! এরপর ডিরেকশান তারপর প্রোডিউসিং! ব্ল্যাক ম্যাজিকের সময় আমার ভালোবাসার এই ক্রমটাই পুরো উল্টে গেছিল।

তার মাঝেও আমি দুবাই রিটার্ন নামের একটা ফিকশন ছবি এডিট করেছি। আদিত্য ভট্টাচার্য, বাসু ভট্টাচার্যের ছেলে, যিনি আমির খানের প্রথম ছবি ‘রাখ’ তৈরি করেছিলেন, তিনিই পরিচালক ছিলেন, ইরফান ছিল ছবিটায়। আমার মতে এটা ইরফানের ওয়ান অফ দা লাভলিয়েস্ট ফিল্মস। কিন্তু ছবিটা মুক্তিই পায়নি, কারণ প্রোডিউসার একটু পাগলাটে ছিল। এই ছবিটা সম্বন্ধে কেউ জানেই না, কয়েকটা প্রাইভেট স্ক্রিনিং-এ হাতে গোনা কয়েকজন দেখেছে।

এছাড়া আমাদের নিজের ছবি এডিট তো করেইছি, আর রীনা মোহনের স্কিন-ডিপ নামের একটা ছবি এডিট করেছি।

কাজেই এই ননফিকশনের ব্যাপারটা পুরোপুরি কো-ইন্সিডেন্টাল। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, আর আমার মনে হয় আমার মতো আরো অনেকেই একইরকমভাবে ভাবেন যে্, একজন এডিটর ডকুমেন্টারি ছবিতেই তার বেস্ট কাজটা করতে পারেন। ফিকশন ছবিতে এডিটিং-এর কাজকে একেবারেই ছোটো করতে চাইছি না আমি, কিন্তু সেখানে সে বড়োজোর একজন দ্বিতীয় শ্রেণির লেখক। ডকুমেন্টারির ক্ষেত্রে এডিটর নিজেই প্রাইমারি লেখক। কাজেই এক্ষেত্রে কাজটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং এবং ফুলফিলিং!

আজকাল আমার আর ফিকশন ছবি দেখতে ইচ্ছেও করছে না। আমি মূলত ডকুমেন্টারি ছবিই দেখি।

রূপক : আপনার সঙ্গে কথা বলার আগে বেশ কিছু হলিউডি ফিকশন ছবির এডিটরদের ইন্টারভিউ শুনছিলাম। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি ওঁদের কথা প্রায় কেউ জানেনই না। অন্যদিকে ননফিকশনের ক্ষত্রে ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। এই ব্যাপারটা কি আপনি যে কাজের গুরুত্বের কথাটা বললেন তার সঙ্গেই রিলেটেড?

অর্জুন : জানি না বস, ছবি তৈরির ক্ষেত্রে এইরকম একটা হায়ারার্কি আছে। খুব মুশকিল! বাই অল লজিক, ছবি তৈরির ক্ষেত্রে ডিরেক্টার নিশ্চই সবথেকে ইম্পর্ট্যান্ট! কিন্তু সেটা অন্য ভূমিকাগুলোকে ছোটো করার মাধ্যমে নয়।

অন্যদিকে ডকুমেন্টারি— মানে আমেরিকান, বা বি বি সি বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা বুসান এই সবধরনের ডকুমেন্টারিতেই ফিকশনের তুলনায় এডিটরদের অনেক বেশি রেসপেক্ট দেওয়া হয়। একটা উদাহরণ দিই। কলকাতায় সবাই বলে যে দুলাল দত্ত সত্যজিত রায়ের ছবি এডিট করেছেন। কিন্তু দুলাল দত্তকে নিয়ে কিন্তু কেউ আলাদা করে মাথা ঘামাচ্ছে না। দুলাল দত্ত উইল বি লাভড, কারণ তিনি রায় বাবুর সঙ্গে কাজ করেছেন, ব্যাস এইটুকুই! এইটা অন্তত ডকুমেন্টারিতে হয় না!

রূপক : এর কারণ কী?

অর্জুন : কারণ ডকুতে এডিটরের কাজটা অনেকটাই বড়ো, অন্তত আমি এটা আমি মনে করি। আবার অন্যদিকে যিনি কাজ করছেন তিনি কাজটাকে ভালোবাসছেন কিনা সেটাও জরুরি। যিনি ডকুমেন্টারি এডিট করছেন না তিনি খারাপ এডিটর তাও কিন্তু নয়।

রূপক : বেশ। এ-প্রসঙ্গেই একটা অন্য প্রশ্ন করি। আপনার তিনটে ছবি গুলাবি গ্যাং, তনভির কা সফরনামা এবং শাট আপ সোনা-য় (প্রথমটা আর শেষেরটা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে) ফিরে গিয়ে ইন রেট্রোস্পেক্ট কাজের পদ্ধতিতে কোনো রকম পার্থক্য দেখতে পান কি?

অর্জুন : এইটা নিয়ে আরো বড়ো পরিসরে আলোচনা হতে পারে।

আমি ১৯৯৫ সালের আগে থেকেই পড়াচ্ছি। এফ টি আইতে আমি যখন প্রথম পড়াতে যাই, বোধহয় ২০০৩, আমার করা ডিপ্লোমা ছবিটা আবার দেখার সুযোগ হয়। ডিপ্লোমা ছবি সাধারণত একজন পরিচালনার স্টুডেন্ট, সাউন্ড ব্যাচের একজন, ক্যামেরার একজন ছেলে বা মেয়ে, আর এডিটিং-এর একজন এই চারজন মিলে বানায়। কাজেই আমার ডিপ্লোমা ছবিটা আমি এডিটিং করি। সেটা আমি শেষ দেখেছি ’৮৯ সালে এফ টি আই ছাড়ার আগে।

এর মধ্যে আমি প্রচুর ছবি এডিট করেছি। ব্ল্যাক ম্যাজিক তুঙ্গে, মাসে ৪-৫টা এ্যাড ছবি নিজে এডিট করেছি। পাতালঘর হয়ে গেছে, বিনামোহনের মতো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া পরিচালকের হিন্দি ছবি এডিট করেছি, এত সব হয়ে গেছে! 

তুমি যেটা জানতে চাইলে, যে ফিরে গিয়ে নিজের কাজ দেখলে কী মনে হয়, আমি নিজে অবাক হয়ে দেখলাম আমি ’৮৯তে যেভাবে এডিট করতাম এখনও ঠিক সেভাবেই এডিট করি! 

রূপক : এর মানে কি আপনি বলছেন আপনার কাজের গ্রামারটা পাল্টায়নি?

অর্জুন : হ্যাঁ, আমি বলছি এটা আমার কাজের ভাষা! এবার কারো পছন্দ হলে হবে, না হলে হবে না!

রূপক : এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা!

অর্জুন : দুঃখজনকও হতে পারে। মেবি আই হ্যাভনট গ্রোন!

রূপক : অথবা ’৮৯ সালের ডিপ্লোমা ছবিতেই আপনি নিজের সিগনেচার খুঁজে পেয়েছিলেন সেটাও তো হয়ে থাকতে পারে?

অর্জুন : হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। ওটা ফিকশন ছবি ছিল। আমি সেদিন যা করেছি আজও তাই করি, কী রাখব, কী রাখব না, কোথায় কাটব, কোথায় কাটব না, আমার ভাবনার পদ্ধতি একদম একইরকম আছে। তুমি যে প্রশ্নটা করলে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলি, ওই তিনটের মধ্যে তনভির কা সফরনামা আমার সব থেকে প্রিয় কাজ। অন্যদুটোও আমার নিজের খুবই পছন্দের, ‘শাট আপ সোনা’ গুলাবি গ্যাং-এর থেকেও প্রিয়, কিন্তু তনভির কা সফরনামা রিমেইন্স মাই ফেভারিট! এডিটিং ইজ এবাউট স্টোরি টেলিং! সত্যি গল্পটাকে জমজমাট করার জন্য আমার যা করার আমি করব। ওটাই আমার ব্যাকরণ!

রূপক : আজকের দিনে নতুন যারা ফিল্প এডিটিং-এ যেতে চায়, তাদের জন্য আপনার অ্যাডভাইস কী? তারা কীভাবে কাজ শিখবে?

অর্জুন : গল্প দ্যাখ, গল্প পড়! আর কোনো অ্যাডভাইস নেই। ভালো ছবি দ্যাখ, আঁতলামো করিস না!

রূপক : ইজ ইট দ্যাট ক্লিয়ার?

অর্জুন : হ্যাঁ! নন-ন্যারেটিভ ইত্যাদি সব হবে, কিন্তু শালা নন-ন্যারেটিভ জন্মেছে কোত্থেকে সেটা তো আগে দ্যাখো! ন্যারেটিভ বুঝে গুলে খেয়ে সেখান থেকে ভেঙে নন ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে। তোমরা গোড়াতেই নন ন্যারেটিভ বলবি? গল্পটা বলা শেখো না! তারপরে বাকি সব হবে। শুনতে সিমপ্লিসটিক লাগতেই পারে, কেউ বলতেই পারে আরে অর্জুনদা কমার্শিয়াল কথাবার্তা বলে! যদি তাই হয় তাহলে তো আমি বিগেস্ট ফেইলিওর! কমার্শিয়াল কথা বললে তো এতদিনে আমার অন্তত একটা ছোটো প্লেন থাকা উচিত ছিল!

ক্যারল রাইস আর গ্যাভিন মিলার মিলে একটা বই লিখেছিল, ‘হাউ টু কাট আ ফিল্ম’, (সেটাকেই এখনও বোধহয় এডিটিং-এর বাইবেল ধরা হয়)। সেখানে আই লাইন ম্যাচ, বাঁদিক থেকে ডানদিক, ডানদিক থেকে বাঁদিক হ্যানাত্যানা এসব নানান নিয়ম বলা আছে। বইটা বাইবেল হয়ে গেছে। কিন্তু আর তারপর লোকদুটো একটা ছবি বানিয়েছিল যার প্রত্যেকটা কাট কনশাসলি গোজ এগেইন্সট দিজ থিওরিজ (হাসি)!

কাজেই হলিউড ছেড়েই দিলাম, আমাদের বাংলা ছবিতে ঋত্বিকের সেন্স অফ এডিটিং এবং সত্যজিতের সেন্স অফ এডিটিং ডু নট ম্যাচ, বোথ বিইং গ্রেটস। রিপিটেটিভ শটের সিনেমা নিয়ে একটা কথা একবার ফিল্ম স্কুলে বলেছিলাম বলে লোকজন খুব চটে গেছিল (হাসি)! ভেবে দ্যাখ, এ্যাকশানজ আর রিপিটেটিভ, অ্যাঙ্গেলস আর লিমিটেড! কাজেই এডিটিং-ই তো বাঁচিয়ে রাখবে!

রূপক : আমার শেষ প্রশ্ন। আপনার কি মনে হয় পাতালঘরের পর আন্তর্জাতিক মানের সায়েন্স ফিকশন সিনেমা আমরা আর পেতে পারি? মানে কোথায় আটকাচ্ছে?

অর্জুন : ’৮৬ সালে ‘ঘরে বাইরে’ বলে একটা ছবি হয়েছিল, ওর থেকে খারাপ ছবি তার পরে আর আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে হয়েছে বলে আমার মনে হয় না, কন্সিডারিং অল ফাকড আপ ফিল্মস টিল ডেট (হাসি!)। একটু আধটু ফ্ল্যাশ হয়তো এরপর এদিক ওদিকে হয়েছে, কিন্তু ঘরে বাইরের পর বাংলা সিনেমার মৃত্যু হয়! বাংলায় কিছু নেই এই মুহূর্তে— নো মিউজিশিয়ান, নো পেইন্টার, নো রাইটার নাথিং! যা হচ্ছে সেটা বাংলাদেশে হচ্ছে। এটা মাড়োয়ারি হিসাবে বলছি বলে আমি ইট পাথর খাব, কিন্তু যেখানে কিছু নেই সেখানে কী করে আমি আরেকটা সাই ফাই ছবি একপেক্ট করব? কেন হবে? আরো একটা কালচারাল রিভাইভাল হলে সবই হবে!

রূপক : সেটা আপনি এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছেন না?

অর্জুন : না আমি এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি না…

রূপক : কিন্তু এই ড্রাই রান কেন?

অর্জুন : লোকে বলবে বামফ্রন্ট সরকার চলে যাওয়ার ফলে এইটা হয়েছে (হাসি)…আমি তা বলছি না!

(সমাপ্ত)

অর্জুন গৌরিসারিয়ার ছবি - সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More