সরকারের মদত থেকে অনিচ্ছাকৃত ‘খুন’ – মানুষের দোষে বারবার প্রাণ হারিয়েছে নিরীহ হাতিরা

বছর ছয়েক আগে সেদেশে হাতি শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, আশ্চর্য লাগলেও সত্যি। সমস্ত পৃথিবীর বন্য প্রাণ যখন সংকটের মধ্যে, তখন তাকে আরও জটিল করে তুলছে বতসোয়ানা সরকার। হাতির সংখ্যা সেখানে এতই বেড়ে গিয়েছে যে, মানুষের সঙ্গে বাঁধছে সংঘাত। আর সেই সংঘাত এড়াতেই হাতি হত্যার উপর বৈধতা দিচ্ছে সরকার। এমনকি সম্প্রতি সরকার এই কাজের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য নিলামের আহ্বানও জানিয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসেই সেদেশের ৭টি শিকারি সংস্থাকে ১০টি করে মোট ৭০টি হাতি শিকারের বরাত দেওয়া হয়েছে।

পশুদের রাজা হিসাবে অভিষেক না হলেও জঙ্গলে তার মহিমা অস্বীকার করা কঠিন। আর পর্যটকদের গভীর বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর এমন বাহন পেলে কে খুশি হবেন না? তবে সেই হাতিরা কি আদৌ খুশি এই জীবিকায়? প্রশ্নের উত্তর বোধহয় খুব সহজ নয়। হাতি কোনো গৃহপালিত জন্তু নয়। তাদের পোষ মানানো সহজ নয়। তবু মানুষ জোর করেই বেঁধে রাখে হাতিদের। শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারও চলে অকথ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে তো এই সমস্যা বেশ ভয়াবহ।

এসবের সঙ্গেই আবার যুক্ত হয় ধর্মীয় অনুষঙ্গও। হিন্দু ধর্মের অনুরাগীরা অনেকেই গণেশের প্রতীক হিসাবে হাতির আরাধনা করে। দক্ষিণ ভারতে এক শীতকাল জুড়ে এই উপাচার তো রীতিমতো উৎসবের চেহারা নেয়। মন্দিরের হাতিরা তখন মাথায় সোনার মুকুট পড়ে, পট্যবস্ত্র পরীহিত হয়ে রাস্তায় হাজির হয়। তাদের দেখতে মানুষের ভিড় ভেঙে পড়ে। কিন্তু যে প্রাণীদের উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়, তাদের কিসে সন্তুষ্টি? এই পোশাকের ভারে নাভিশ্বাস হয়ে ওঠে তাদের।

হাতিদের উপর মানুষের অত্যাচারের নানা ছবি ছড়িয়ে আছে বহুদিনের ইতিহাসে। হাতিদের যে একটা আলাদা সমাজ থাকে, তা আমরা আদৌ মনে রাখি না। এমনকি আজও সেই শোষণের প্রবাহ চলেছে। শুধুই মানুষের সংস্কৃতিতে নয়, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও অনেক সময়েই দায়ী। রেললাইন তো হাতিদের দীর্ঘদিনের শত্রু। রেলগাড়ি ছাড়া আধুনিক মানুষের জীবন প্রায় অচল। অথচ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যখন রেলগাড়ি ছুটে যায়, হাতিরা আদৌ সেকথা জানতে পারে না। হয়তো আনমনে কেউ হেঁটে যাচ্ছে লাইনের উপর দিয়ে। আর তখনই পিছন থেকে আচমকা ধাক্কায় শেষ হয়ে গেল সমস্তকিছু। ২০১৮ সালে ওড়িশার তেলিডিহি গ্রামে একসঙ্গে চারটি হাতির মৃত্যু হয় মালগাড়ির ধাক্কায়। গতবছর দার্জিলিং-এর কাছে বাতাসি গ্রামেও দুটি হাতির মৃত্যু ঘটেছে একইভাবে। অথচ এই দুর্ঘটনা এড়ানোর কোনো বাস্তব সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না কেউই।

আবার সবটা যে দুর্ঘটনা এমন নয়। আফ্রিকার বতসোয়ানার কথা আগেই বলা হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে যখন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কথা উঠছে, বতসোয়ানা তখন প্রাণী হত্যাকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। প্রায় তেমনই উদ্যোগ নিচ্ছে প্রতিবেশী দেশ জিম্বাবোয়েও। পৃথিবীর যেকোনো দেশকে নিঃশর্তে হাতি বিক্রি করতে রাজি জিম্বাবোয়ে সরকার। আপাতভাবে মনে হতে পারে, এ তো বিক্রি। হত্যা নয়। কিন্তু প্রাণী বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর ফলে বেশ সমস্যায় পড়বে হাতিরা। অন্য পরিবেশে, অন্য আবহাওয়ায় মানিয়ে নেওয়া যে খুব সহজ নয়। আর তার পরিণামে মৃত্যুও যে অস্বাভাবিক নয়।

আসলে মানুষের অস্তিত্বই যেন প্রকৃতির একমাত্র উদ্দেশ্য, এটাই ধরে নিয়েছি আমরা। আর বাইরেও যে বহু প্রাণীর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, সেকথা আমরা আদৌ মনে রাখি না। ছোট প্রাণীরা তবু হয়তো মানিয়ে নিতে পারে মানুষের এই চরিত্রের সঙ্গে। কিন্তু হাতির মত বৃহৎ প্রাণীর পক্ষে তা সত্যিই কঠিন। আর তার জন্যই আজ অস্তিত্বের সংগ্রামে মুখোমুখি দুই প্রতিপক্ষ, মানুষ এবং হাতি।

Powered by Froala Editor