বক্তৃতায় মৃত্যুর ছায়া, পরেরদিনই দেহরক্ষীদের গুলিতে ঝাঁঝরা ইন্দিরা!

১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবরের দিনটি ঝলমল করছিল রোদে। একটু একটু করে শীত পড়ছে নতুন দিল্লিতে; তাই এই রোদ বেশ উপভোগ করা যায়। ১ নং সফদরজঙ্গ রোডের বিশেষ বাড়িটি জেগে উঠেছিল আগে আগেই। তাড়াতাড়ি নিজেকে তৈরি করে ব্রেকফাস্ট টেবিলে হাজির হয়েছিলেন বাড়ির কর্ত্রী, এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। কিছুক্ষণ পরেই তথ্যচিত্র নির্মাতা পিটার উস্তিনভের সঙ্গে একটা মিটিং করার কথা। খাওয়া সেরে নিরাপত্তারক্ষী ও ব্যক্তিগত সচিবের সঙ্গে বেরিয়ে এলেন ইন্দিরা। পরনে কালো পাড়ের একটি গেরুয়া রঙের শাড়ি…

সফদরজঙ্গ রোডের পাশেই আকবর রোডে ছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর। দুই ভবনের মাঝের লাগোয়া রাস্তা দিয়েই এগোচ্ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। হঠাৎই পাশ থেকে কান-ফাটানো আওয়াজ। ইন্দিরা দেখলেন, পেটে এসে বিঁধেছে একটি গুলি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে আঁচল। আর পাশেই রিভলভার উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নিরাপত্তারক্ষী বিয়ন্ত সিং। কিছু বোঝার আগে আবারও ছুটে এল দুটো গুলি। লুটিয়ে পড়লেন ভারতের লৌহমানবী। বিয়ন্ত সিংয়ের পেছনেই অটোমেটিক কার্বাইন নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সৎবন্ত সিং। মুহূর্তের দোলাচল থামিয়ে কার্বাইন চালাতে শুরু করলেন তিনি। রাস্তা ভেসে গেল রক্তে। আর সেই রক্তের ওপর পড়ে রইলেন নিথর ইন্দিরা… 

ঠিক একদিন আগের কথা। ওড়িশার ভুবনেশ্বরে হাজির হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সূচি মেনে হাজির হয়েছিলেন বক্তৃতা দিতে। প্রতিবারের মতো এবারও ভাষণের খসড়া এগিয়ে দিলেন এইচ ওয়াই শারদাপ্রসাদ। মঞ্চে উঠলেন ইন্দিরা। প্রত্যেকে প্রধানমন্ত্রীর কথা শোনার জন্য অপেক্ষায়। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়েই বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন তিনি। 

কিন্তু এ কী বলছেন! এ যে খসড়ার বাইরে চলে যাচ্ছেন তিনি। স্থির, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে একের পর এক কথা বলে যাচ্ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ‘আমি আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি। কিন্তু আমার মনে কোনো অনুতাপ নেই। অনেকদিন বেঁচেছি। যে কদিন বেঁচেছি, দেশের কথা ভেবেছি।’ যেন রক্তের দাগ তিনি দেখতে পেয়েছেন সামনে। প্রতিটা কথায় আসন্ন মৃত্যুর পূর্বাভাস। ইন্দিরা কি ভবিষ্যৎবক্তা ছিলেন? পরবর্তীকালে গবেষকরা বারবার চোখ রেখেছেন ১৯৮৪ সালের ৩০ অক্টোবরের ওই সভার দিকে। হঠাৎ কেনই বা অমন কথা বলতে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। এমনভাবে তো এর আগে তাঁকে দেখেনি দেশ! ইন্দিরা গান্ধীর পুরো ভাবই বদলে গিয়েছিল। কী হল হঠাৎ, যে এমন কথা বলছেন? 

ওড়িশার রাজ্যপালও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন এমন ভাষণ শুনে। কিন্তু ইন্দিরা অনড়। তিনি যা বলেছেন, মন থেকে বলেছেন। তাড়াতাড়িই ফিরে গিয়েছিলেন দিল্লি। রাতে সেরকম ঘুমোননি। পরেরদিন যাকে বলে একেবারে ‘টাইট শিডিউল’। সকালবেলায় পরিচালক পিটার উস্তিনভের সঙ্গে দেখা করার কথা। ইন্দিরা গান্ধীর ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করবেন বলেছিলেন ইনি। সেইজন্যই সময় দেওয়া। এদিকে ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীও এসেছেন। সন্ধের দিকে ব্রিটেনের রাজকুমারীর সম্মানে একটা ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। সেখানেও যেতে হবে। ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ানের মাধ্যমে সেই খবর পৌঁছে দিয়েছেন বিদেশে সফররত রাষ্ট্রপতি গিয়ানী জৈল সিংকে। তারপর বেরোলেন আকবর রোডের দিকে। 

কয়েকদিন আগে থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আসছিলেন গোয়েন্দা প্রধানরা। গোপন সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রীর ওপর নাকি হামলা হতে পারে। ১৯৮৪ সালেরই জুন মাসে অমৃতসর স্বর্ণ মন্দিরে হানা দেয় ভারতীয় সেনা। খলিস্তানি বিদ্রোহ দমন করতে নেওয়া হয় ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। খলিস্তানি নেতা সন্ত জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে-সহ প্রায় ৪৯৩ জন শিখ নিহত হন স্বর্ণমন্দিরে। ইন্দিরা গান্ধী কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, এই দাবিতে শিখদের ভেতরে ভেতরে ক্ষোভও বাড়ছিল। গোয়েন্দা প্রধানরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীদের থেকে শিখদের বাদ দিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু এমন প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিলেন ইন্দিরা। কাউকে বের করা যাবে না। গোয়েন্দা রিপোর্ট যে ভুল ছিল না, তা বোঝা গেল ৩১ অক্টোবর। নিজের দুই দেহরক্ষীই গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল ইন্দিরার শরীর। সফদরজঙ্গ রোডে একটি অ্যাম্বুলেন্সের বন্দোবস্ত থাকত সবসময়। নিয়তির এমন খেলা, ঠিক সেইদিনই চালক ছুটি নিয়েছিলেন। তাড়াহুড়োতে দিল্লির এইমসে কেউ ফোনও করেনি। হাসপাতালে পৌঁছেও সময় চলে গেল বেশ খানিকটা। ততক্ষণে… 

আরও পড়ুন
'আমার প্রার্থনার রাম, দশরথপুত্র ও অযোধ্যার রাজা সেই ঐতিহাসিক রাম নন', বলেছিলেন গান্ধীজি

তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন ডাক্তাররা। কিন্তু শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলি মারাত্মকরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। হাড় ভেঙে গেছে, মাথাতেও চোট লেগেছে। তার ওপর রক্ত বেরিয়ে গেছে প্রচুর। দুপুর ২টো ২৩ মিনিট। যাত্রা থামল লৌহমানবীর। সন্ধে ৬টার সময় জানল গোটা দেশ। ভুবনেশ্বর তখনও ভোলেনি ইন্দিরার শেষ বক্তৃতার কথাগুলো। এরই কি নাম নিয়তি?…     

তথ্যসূত্র – ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড : যেভাবে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল দুই দেহরক্ষী’, বিবিসি বাংলা      

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে পত্রিকা প্রকাশ, গ্রেপ্তার কবি শম্ভু রক্ষিত

More From Author See More