দেশের রোজগেরে মহিলাদের ৮৩ শতাংশই ঠিকা শ্রমিক; অস্বাভাবিক কম পারিশ্রমিকে দিন গুজরান

অ্যানি বেসান্ত ভারত সম্পর্কে বলেছিলেন, এদেশের মানুষ মহিলাদের সম্মান দিতে জানে। সেদিনের সেই মূল্যায়ন কতদূর সার্থক ছিল, সে প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু আজকে একুশ শতকে দাঁড়িয়েও কি মহিলাদের উপযুক্ত সম্মান দিতে প্রস্তুত ভারতীয় সমাজ? নাকি মাতৃত্বের কাল্পনিক ভাবমূর্তির আড়ালে মহিলাদের যাবতীয় শ্রম শোষণ করেই টিকে আছে এদেশের অর্থনীতি? তাঁদের শ্রমের কতটুকু মূল্য দিয়েছে ভারতের সমাজ?

সাম্প্রতিক বেশ কিছু সমীক্ষায় উঠে এসেছে এদেশের মহিলাদের করুণ অবস্থার কথা। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমস্ত ক্ষেত্রেই এগিয়ে এসেছেন আজকের মহিলারা। কিন্তু তবুও পিতৃতন্ত্রের নিগড় থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের এখনও ঢের বাকি। আজও মহিলাদের অন্তিম পরিণতি হিসাবে ধরে নেওয়া হয় উপযুক্ত কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়েকেই। কিন্তু অর্থনৈতিক কাঠামোয় একেবারে নিচের দিকে যে সমস্ত পরিবার? যাঁদের একক সদস্যের রোজগারে সংসার চলে না? সেখানে কিন্তু সমান অধিকারের দাবিতে নয়, বরং পেটের দায়েই কর্মক্ষেত্রে নামতে হয় মহিলাদের।

বিগত কয়েক বছরের লেবার ফোর্স সার্ভে রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে এদেশের রোজগেরে মহিলাদের প্রায় ৮৩ শতাংশই কাজ করেন ঠিকা শ্রমিক হিসাবে। অর্থাৎ লিঙ্গসাম্যের আলোকময় জগৎ থেকে তাঁদের অস্তিত্ব অনেক দূরে। তাঁরা জানেন ‘গতর খেটে’ কোনোরকমে পেট চালাতে হবে। কিন্তু তাঁদের পরিশ্রমের উপযুক্ত পারিশ্রমিক কি পান তাঁরা?

একটু খোঁজ নিলেই দেখতে পাব, আমাদের চারপাশে এখনও মহিলাদের জন্য বেশ কিছু কাজের সুযোগ দেখা যায়। যেমন, সফট টয়েজ তৈরি, রাখি তৈরি, কাপড়ে পার বসানো, অন্যান্য সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ। এসবের থেকে আয় কেমন? না, এইসব ক্ষেত্র এখনও লেবার অ্যাক্টের আওতায় আসেনি। অর্থাৎ কাজের নিরাপত্তা তো নেইই, নেই রোজগারের নিরাপত্তাও। হয়তো একেকটি রাখি পিছু হাতে থাকা মাত্র কিছু পয়সা, একটা সফট টয়েজের জন্য বড়জোর ২০ টাকা। হ্যাঁ, সারাদিনের পরিশ্রমের আয় বড়জোর ৫০-৬০ টাকা। কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো কাজের সুযোগও তো নেই তাঁদের কাছে।

আরও পড়ুন
করোনা রোগীদের বিনামূল্যে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন শিলিগুড়ির প্রথম মহিলা টোটোচালক

২০১১ সালের একটি সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী তখন দেশের সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকের মধ্যে ৭০ শতাংশই মহিলা। এঁরা কাজ করেন নির্মাণ প্রকল্পে অথবা কারখানার সস্তা শ্রমিক হিসাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের নাম সই করার মতোও শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। না, পড়াশোনার সুযোগ দেয়নি আমাদের সমাজ। আর তাই খাতায়-কলমে তাঁদের যে মজুরি দেওয়া হয়, তার বেশিরভাগটাই চলে যায় মধ্যস্থতাকারীদের পকেটে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের অবাধ প্রতিযোগিতা কোনোভাবেই পিতৃতন্ত্রের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেয়নি মহিলাদের। মহিলাদের জন্য ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর প্রকল্পও এখানে সামাজিক শোষণের যান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হতে বাধ্য। সেখানেও নেই উপযুক্ত কাজের পরিবেশ। আর ঘরের বাইরে? সেখানে আরেক কঠিন বাস্তবের সামনে পড়তে হয় মহিলাদের। তাঁরা সেখানে পুরুষের বিকৃত চাহিদার সামনে অসহায়। অথচ রোজগার ছাড়া তো বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়। শুধু যে আর্থিকভাবে দুর্বল সমাজের অবস্থাই এমন, তাও আবার নয়। সমস্ত ক্ষেত্রেই পুরুষের থেকে মহিলাদের কাজের মূল্য অনেক কম। সিনেমার নায়িকারাও তো নায়কের থেকে কম পারিশ্রমিক পান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। কিন্তু দেশকে প্রকৃত অর্থে উন্নত করে তুলতে গেলে তো সার্বিক সাম্যের বার্তাই তুলে ধরতে হবে। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষকে পিছিয়ে রেখে দেশ এগোবে কীভাবে? 

আরও পড়ুন
সম্মানজনক কাজ নেই; ড্রাগ পাচার চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মহিলারা

তথ্য ঋণঃ সোসিও-ইকোনমিক ডেভালাপমেন্ট অ্যান্ড জেন্ডার ইন-ইক্যুয়েলিটি ইন ইন্ডিয়া, মিনা রাজভি, নর্থার্ন ইলিনয়েস ইউনিভার্সিটি

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
আদিবাসী মহিলাদের নিয়ে তৈরি বিশেষ ব্যাটেলিয়ান, ভারতে প্রথম

More From Author See More