আশি বছর আগেই আফ্রিকায় শ্যুটিং করেছিলেন এই বাঙালি পরিচালক

২০১৩ সালের শুরুর দিকে যখন বাঙালির নস্টালজিক অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীটিকে পর্দাবন্দি করবেন বলে জানিয়েছিলেন নবাগত পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, তখন যাবতীয় উচ্ছ্বাস, পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশার পাশাপাশি অসম্ভব ঝুঁকির কথা ভেবে রীতিমতো রোমাঞ্চ অনুভব করেছিল তামাম বাংলার দর্শক। বাঙালির কাছে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর পরিচিতি আসলে কেবলই নস্টালজিক অ্যাডভেঞ্চারের আখ্যান হিসাবে নয়, বরং তা ছিল নবজন্ম লাভ করা জাতির যোগ্যতর এক প্রতিনিধির গল্প।

আরও পড়ুন
স্যালুট না জানানো এক বিষণ্ণ বাবা আর ইতিহাস হয়ে যাওয়া সেই ছবির গল্প

১৯৩৫ থেকে ‘মৌচাক’-এ ধারাবাহিক প্রকাশের পর ১৯৩৭-এ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল ‘চাঁদের পাহাড়’, সেই বছরেই সেলুলয়েডে মুক্তি পেল ওয়াদিয়া মুভিটোন প্রযোজিত ও হোমি ওয়াদিয়া পরিচালিত ‘তুফানি টারজান’, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘আবার যকের ধন’-এর বয়সও তখন চার পেরিয়ে গেছে, অর্থাৎ ভারতীয়দের কাছে আফ্রিকা ক্রমেই সাহিত্য ও বিনোদনের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর ঠিক এই সময়েই প্রথম ভারতীয় হিসাবে খোদ আফ্রিকার মাটিতেই শুটিং করতে গিয়েছিলেন যে মানুষটি, তিনিও কিন্তু এক বাঙালিই। তাঁকে প্রায় ভুলেই গেছি আমরা। তিনি হীরেন্দ্রকুমার বসু, সংক্ষেপে হীরেন বসু। চিত্র পরিচালক হওয়ার পাশাপাশি একাধারে ছিলেন গীতিকার, সঙ্গীতশিল্পী, নাট্যাভিনেতা, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। ধ্রুপদ ও খেয়াল শিখেছিলেন। প্রথম দিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্র-গীতি, রজনীকান্তের গান গাইলেও পরে নিজে গান লেখা শুরু করেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রথম নেপথ্যশিল্পী হিসাবে কণ্ঠদান করেছিলেন ‘জোর বরাত’ ছবিতে, ১৯৩১ সালে। তাঁর লেখা গানগুলির মধ্যে ‘আজি এ শারদ প্রাতে’, ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে’, ‘বাউরী হয়েছে আজ শ্রীরাধা’ বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ১৯৩৮ সালের পুজোর সময় দিল্লিতে বিশিষ্ট গান্ধিবাদী কংগ্রেস নেতা ও ব্যবসায়ী শেঠ গোবিন্দদাসজীর সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনা তাঁকে সম্পূর্ণ নতুন এক মাইলস্টোনের দিশা দেখাল।

ছবিটির নাম ঠিক করেছিলেন ‘ইন্ডিয়া ইন আফ্রিকা’ বা ‘আফ্রিকা মে হিন্দ’।

১৯৩১ সালে আফ্রিকার পটভূমিকায় নির্মিত প্রথম কাহিনীচিত্র ‘ট্রেডার হর্ন’ মুক্তি পেল হলিউডে। সেই ছবিতে আফ্রিকার আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে ইউরোপীয়দের ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টির উপস্থাপনা পছন্দ হয়নি গোবিন্দদাসজীর। তাঁর বক্তব্য ছিল, ইউরোপীয় বণিকদের বহু আগে ভারতের কাথিয়াবাড় উপদ্বীপের ব্যবসায়ীগণ আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করেছিল। সেইমতো হীরেনকে আফ্রিকায় গিয়ে সম্পূর্ণ একটি ভারতীয় ছবি বানানোর জন্য বলেছিলেন তিনি। একটি ছোট স্ক্রিপ্টও বানিয়েছিলেন, সঙ্গে অল্পবিস্তর নোটস। ছবিটির নাম ঠিক করেছিলেন ‘ইন্ডিয়া ইন আফ্রিকা’ বা ‘আফ্রিকা মে হিন্দ’। শুটিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ ছাড়া ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে লোকবলও জোগাড় করেছিলেন তিনি। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ও উৎসাহদানে বোম্বাই বন্দর থেকে ১৯৩৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি পরিচালক হীরেন বসু-সহ একটি সম্পূর্ণ ফিল্ম ইউনিট যাত্রা করলেন মোম্বাসার উদ্দেশ্যে। জাহাজটির নাম ছিল এস. এস. টাক্লোয়া। ভারত মহাসাগরের উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক, বিশ্বখ্যাত চীনা যাদুকর চ্যাঙের যাদু প্রদর্শন, এক বসন্ত-আক্রান্ত যাযাবর রমণীর জন্য সেশ্যেলস দ্বীপে করেনটাইন, সেখানে আদিবাসী-নৃত্য, রাতের আঁধারে উটপাখির দল-জাহাজযাত্রার খুঁটিনাটি সবই পরে হীরেন লিপিবদ্ধ করেছিলেন ‘বনে জঙ্গলে’ বইতে।

তখনও আফ্রিকার কালো মানুষ আর ভারতীয় সংকর জাতির মধ্যে অন্তত অবহেলিত হওয়ার দিক থেকে কোনো প্রভেদ নেই। একজন শ্বেতাঙ্গও যদি রেলের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় থাকে, তাহলেও জায়গা হবে না কোনও আফ্রিকান ও ভারতীয়র। যে মহাদেশে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে টিকেট থাকা সত্ত্বেও ফার্স্ট ক্লাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক খর্বকায় ভারতীয় উকিলকে, পরবর্তীকালে তাঁর দীর্ঘ আন্দোলন যে সেখানকার শ্বেতাঙ্গ মনোভাবে কোনো প্রভাবই ফেলেনি, তাই যেন প্রকট হয়ে উঠেছিল হীরেনের দলের আফ্রিকা-অভিযানের প্রতিটি পদক্ষেপে। মোম্বাসা থেকে নাইরোবি যেতে তাই মোটরে রওনা হতে হয়েছিল সকলকে। মোম্বাসার প্রায় সর্বত্র ইংরেজদের হোটেলে ভারতীয়দের জন্য জায়গা হত না। হীরেনদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের কলাকুশলীদেরও। তাঁরাও ফিল্ম তুলতে এসে উঠেছিলেন ঠিকা জলপ্রপাতের কাছে একটি হোটেলে। তাঁদের সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় হীরেনও সেখানে যেতে চাইলে তাঁদের আফ্রিকা-নিবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ী মি. প্যাটেল তাঁকে নিরস্ত করে বলেন এই বর্ণবিদ্বেষী মনোভাবের কথা।

হীরেনের বই জুড়ে আফ্রিকার অভিযান-রোমাঞ্চ, ফিল্ম শুটিংয়ের গল্প, আফ্রিকার পরিবেশ-প্রকৃতির বর্ণনার ঔজ্জ্বল্য ছাড়া অনেক বেশি মূর্ত হয়ে উঠছে ঔপনিবেশিক শোষণের পর্যায়-পরম্পরা। আফ্রিকার মাটি থেকে খনিজ সম্পদ তুলে নিয়ে যাওয়ার গল্প বলে তারা নিজেদের দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিতে চায়, কিন্তু সেখানে যেন কোথাও মিশে থাকে প্রচ্ছন্ন অন্যায় অহংকার। প্রকৃতির দানকে অবলীলায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে তারা সেখানকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত করছে। পরবর্তীকালে একই শোষণের পথে হেঁটেছেন চলচ্চিত্র-নির্মাতারাও। বিনোদনের প্রয়োজনে অবাধে তৃণভোজী প্রাণী হত্যা করে সিংহদের সামনে ফেলে তাদের করে তুলেছে লালায়িত। হীরেন লিখেছেন- ‘কোট-প্যান্টপরা ব্যক্তি যদি ওদের অতি সন্নিকটেও যায় তো তাকে বড় একটা কিছু বলে না।’ আবার সেই বিনোদনের প্রয়োজনেই খাবারের লোভ দেখিয়ে হত্যা করা হয়েছে পশুরাজদের। অনেক সময় সরাসরি সিংহ শিকারের বাস্তব পরিস্ফুটন করতে বকশিশ দিয়ে কাজে লাগানো হত মাসাই যোদ্ধাদেরও।

সিংহের ছবি তোলার জন্য হীরেনের ফিল্ম ইউনিটও এই একই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। সুইডিশ শিকারী একম্যানের গুলিতে জেব্রা পরিবারের পুরুষ জেব্রাটির মৃত্যু হীরেনকে ব্যথিত করলেও তাঁকে তা দেখতে হয়েছে কাজের স্বার্থেই। কারণ, জেব্রা মেরে খেতে না দিলে প্রায়-পোষা সিংহের দল শিবিরেরই কোনো মানুষকে তুলে নিয়ে যাবে। ছ’হাজার মাইল সাফারিতে চাঁদের পাহাড়ের অবর্ণনীয় দৃশ্য, বর্শার সাহায্যে মাসাই যোদ্ধার সিংহ শিকার, এন্টিবির বিচারক কুমিরযুগল, তার একটির পিঠে চড়ে জাদুকর-মাহুতের জলবিহার, ঘুমপাড়ানি মাছিদের হাত থেকে বাঁচতে ক্যামেরা কাঁধে গলা অবধি জলে ডুবে বসে থাকা এমন নানা রোমহর্ষক ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার পাশাপাশি কোথাও যেন কাঁটা হয়ে ফুটে থাকে রুক্ষ, অভাগিনী আফ্রিকার বিষাদগাথা। মোম্বাসার কাফ্রি বস্তির সেই কন্যা-হারা দুঃখিনী মেয়েটি, যে তার পলাতক বাঙালি স্বামীর খোঁজ পাওয়ার জন্য ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত হীরেনকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তার ঘরে, কিংবা, রাস্তার উপর ক্যামেরা দাঁড় করিয়ে চাঁদের পাহাড়ের ছবি তোলার সময় হুড়মুড়িয়ে এসে পড়া শ্বেতাঙ্গদের মোটরের সামান্য ব্রেক না কষার বর্ণবাদী ন্যারেটিভ, অথবা, অরণ্যের অভিযান সেরে ফেরার দিন নরখাদক পিগমিদের ইউনিটের বয় মিকোয়াকে তুলে নিয়ে যাওয়ার করুণ সমাপ্তি-সবই যেন সেই ঔপনিবেশিক শোষণের অপবিত্র ‘স্পর্শে’র কর্মফল।

হীরেন্দ্রকুমার বসুর আফ্রিকা-দর্শনে কল্পনা আর রোমাঞ্চের চেয়ে অনেক বেশি ছিল বাস্তবতা।

More From Author See More