সিনেমা নির্মাণের শেষে মৃত্যু নায়কের, হত্যা-মামলায় অভিযুক্ত প্রযোজক!

একসময় হলিউডের বাণিজ্যিক জগৎ মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি। বিতর্ক তো ছিলই। কিংবদন্তি চলচ্চিত্র প্রযোজক হাওয়ার্ড হিউগ তখন মৃত্যুশয্যায়। সেটা ১৯৭০-এর দশক। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্রমাগত দেখে চলেছেন একটিই সিনেমা। তার নাম ‘দ্য কনকারার’। কোনো কোনো দিন ৪-৫ বার দেখে চলেছেন। হাওয়ার্ড হিউগের অন্যান্য সিনেমাগুলির মতোই এটিও সমান বিতর্কিত। শুধু তাই নয়, সমালোচকদের কারোর কারোর মতে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ছবিগুলির একটি ‘দ্য কনকারার’। সাধারণ দর্শক অবশ্য এই ছবি দেখার সুযোগ পাননি। কারণ তার প্রিন্ট মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ১২ মিলিয়ন ডলার খরচ করে সব কপি কিনে নিয়েছিলেন প্রযোজক নিজেই। বলা ভালো, কিনতে বাধ্য হয়েছিলেন।

আসলে এই ছবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অন্ধকার ইতিহাস। একসময় সিনেমাটি বানানোর জন্য হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হতে হয়েছিল হাওয়ার্ড হিউগকে। বলা ভালো, সেই মামলার শাস্তি হিসাবেই তাঁকে কিনে নিতে হয়েছিল সিনেমার প্রত্যেকটা কপি। গল্পটা তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করা যাক। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমার বিষয়বস্তু চেঙ্গিজ খাঁয়ের জীবন ও মঙ্গল রাজত্বের ইতিহাস। চেঙ্গিজ খাঁয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন হিউগের ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম বিতর্কিত এক অভিনেতা জন ওয়েন। তাঁর অভিনয় কুশলতা নিয়ে সমালোচকরা বিতর্ক চালালেও দর্শকদের কাছে ছিলেন সুপারস্টার। তবে চেঙ্গিজ খাঁয়ের চরিত্র তিনি কতটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন, সিনেমার কাহিনিই বা কতটা ইতিহাসনিষ্ঠ ছিল, তা আলোচনার বিষয় নয়। আলোচনার বিষয় হল এই সিনেমার সেট।

সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল উটাহ শহরের পরিত্যক্ত পরমাণু পরীক্ষাকেন্দ্র সেন্ট জর্জে। প্রযোজকের মনে হয়েছিল, চেঙ্গিজ খাঁয়ের মঙ্গোলিয়ার দৃশ্য তুলে ধরার জন্য এর থেকে ভালো জায়গা আর হতে পারে না। অনেকেই অবশ্য তখন বারণ করেছিলেন। পারমাণবিক বিষ্ফোরণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে অবশ্য তখন এত গবেষণা হয়নি। কিন্তু যেখানে ৫ বার পরমাণু বিষ্ফোরণ পরীক্ষা করা হয়েছিল, সেই ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে অভিনয় না করাই ভালো। তবে হাওয়ার্ড হিউগ কোনো কথাই কানে তোলেননি। দুই সপ্তাহ ধরে সেন্ট জর্জেই চলল শ্যুটিং। এখানেই থেমে থাকলেন না হিউগ। অল্প যে কয়েকটি দৃশ্য বাকি ছিল, তার জন্য সঙ্গে করে নিয়ে এলেন কয়েক টন ছাই। হলিউডের স্টুডিওর মধ্যে তৈরি হল ছাইয়ের সেট। হইহই করেই হল সমস্ত শ্যুটিং। কিন্তু সমস্যা শুরু হল এর কিছুদিন পরেই।

সিনেমায় অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে আনুসাঙ্গিক কর্মী, সব মিলিয়ে মোট ২২০ জন কাজ করেছিলেন ইউনিটে। দেখতে দেখতে তাঁদের মধ্যে ৯১ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হলেন। মৃত্যু হল ৪৬ জনের। মৃতদের মধ্যে ছিলেন খোদ সিনেমার নায়ন জন ওয়েন। এছাড়াও ছিলেন অ্যাগনেস মুরহেড, সুজ্যান হেয়ার্ডের মতো শিল্পীরাও। প্রতিটা মৃত্যুর জন্যই যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ দায়ী, তাতে সন্দেহ রইল না। প্রবল সমালোচনার মুখে পড়লেন প্রযোজক। শেষ পর্যন্ত সিনেমার সমস্ত প্রিন্ট কিনে নিয়ে বিতর্ক সামাল দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের মন থেকে অপরাধবোধ ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। শেষ জীবনে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন হাওয়ার্ড হিউগ। শুধুই এই একটি সিনেমা দেখে যেতেন ক্রমশ। চেঙ্গিজ খাঁয়ের হাতে যেমন বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তেমনই রক্তাক্ত এই সিনেমাও। ঠিক একইরকম ঘটনা ঘটেছিল আরও ২ দশক পর রাশিয়ার কিংবদন্তি পরিচালক আন্দ্রে তারকভস্কির ‘স্টকার’ ছবিটিকে ঘিরেও। সেই গল্প অন্য কোনোদিন...

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More