১৯০৮ সালের ১০ নভেম্বর। আলিপুর জেলের ফাঁসির মঞ্চে হাজির হয়েছেন এক তরুণ। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করার পর শরীরটা ঈষৎ ভারী হয়ে গেছে। শরীর দুর্বল হয়নি একটুও; বরং বাড়তি স্ফূর্তি জেগেছে। হাত বেঁধে বধ্যভূমিতে দাঁড়ানোর পর কালো কাপড়ে মুখ ঢাকতে এগিয়ে এল জল্লাদ। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল তরুণের গলা। এ কী করছে! এরকমভাবে ‘মুখ কালো করে’ তো মরতে পারবেন না তিনি। জল্লাদকে বললেন এই কাপড় সরিয়ে রাখতে। এগিয়ে গেলেন সাপের ফণার মতো ঝুলে থাকা দড়িটির দিকে। আহ, শান্তি! দেশদ্রোহীকে শেষ করে এবার মৃত্যুকে বরণ করে নেবেন। ব্রিটিশ পুলিশের চোখের দিকে চোখ রাখলেন কানাইলাল দত্ত। মৃত্যুভয় নেই, সেখানে জ্বলছে আগুন। বিপ্লবের আগুন। লিভার টানলেন জল্লাদ…
কানাইলালের খবর তখন গোটা কলকাতায় ছড়িয়ে গেছে। একে বঙ্গভঙ্গের জ্বালা, তার ওপর এমন বীর বিপ্লবীর ফাঁসি। লাখ লাখ মানুষ নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। আলিপুর জেল থেকে বের করা হল কানাইলাল দত্তের মরদেহ। শববাহী খাটটি একবার অন্তত ছুঁয়ে দেখতে চায় বাঙালি। জেলের ভেতর বসে রাজসাক্ষীকে হত্যা করা, ব্রিটিশের চোখে চোখ রেখে লড়াই করে যাওয়া— মুখের কথা নাকি! কেওড়াতলা মহাশ্মশানও সেদিন লোকে লোকারণ্য। সবার মুখে একটাই কথা— ‘কানাই দত্তের জয় হোক’! তারপরেই ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা। দাহকার্য শেষ হবার পর কানাইলালের চিতাভস্ম নেওয়ার জন্য রীতিমতো লড়াই শুরু হয়ে যায়। টাকা দিয়ে লোকেরা কিনে নিয়ে যায় সেই ‘ভস্ম’। সেখানে ঠিক কতটা কানাইলালের দেহাবশেষ ছিল, তা নিয়ে পরে অনেকেই সন্দেহপ্রকাশ করেছেন। অত ভস্ম একজন মানুষকে দাহ করার পর থাকে নাকি! কিন্তু মানুষের মধ্যে দেশাত্মবোধ, স্বাধীনতার চেতনা এমন পর্যায় পৌঁছে গিয়েছিল যে, কোনোকিছুর দিকে খেয়াল করেনি কেউ।
ইতিহাসের পাতায় হোক, বা ‘ভস্ম’— কানাইলাল দত্ত নানা রূপে বাংলার বুকে উপস্থিত হয়েছেন। চন্দননগরে নিজের মামার বাড়িতে জন্ম তাঁর, ১৮৮৭ সালে। যেদিন জন্মেছিলেন, সেটি ছিল জন্মাষ্টমীর পুণ্য তিথি। সাধ করে দত্তবাড়ির পরের প্রজন্মের ছেলেটির নাম রাখা হল ‘কানাইলাল’। বাবা চুনীলাল সরকারি কাজের সূত্রে ছিলেন বম্বেতে (মুম্বই); সেখানেই ছোটবেলায় চলে যান কানাই। পরবর্তীকালে ১৯০৩ সালে চন্দননগরে ফিরে ভর্তি হন দুপ্লে কলেজে। সেই সময় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিই তাঁর জীবনে মস্ত প্রভাব ফেলেন। যার মূলে ছিলেন এখানকারই এক অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়। তাঁর কাছ থেকেই বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন কানাইলাল। ধীরে ধীরে বাংলার বিপ্লবের মানচিত্রে ঢুকে পড়েন তিনি। নরমপন্থী নয়, শুরু থেকেই তিনি ছিলেন লড়াইয়ের পক্ষে। ইংরেজদের তাড়াতে গেলে বন্দুক-বোমা ছাড়া গতি নেই। তাঁদের মনে ভয় ঢোকাতে হবে; দেখিয়ে দিতে হবে ভারতীয়দের শক্তি।
যুগান্তরে যোগ দেওয়ার পর একবার কেবল ম্যালেরিয়া কাবু করেছিল তাঁকে। নয়তো হার মানার ছেলেই নন কানাইলাল। পুরী থেকে সুস্থ হয়ে কলকাতায় ফেরার পর আবার শুরু করেন বিপ্লবের কাজ। হেমচন্দ্র দাসের কাছে শিখছেন বোমা তৈরির কৌশল। এমন সময় লর্ড কার্জন বাংলার ওপর দিয়ে ছুরি চালালেন। ভাগ করে দিলেন পুরো প্রদেশটাকে, যাতে বাঙালিদের শিরদাঁড়া ভেঙে পড়ে। এখনও মুখ বন্ধ করে থাকবে মানুষ? দল বেঁধে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল মানুষ। এই সময় কানাইলাল দত্তদের আড্ডা ছিল ১৫ নম্বর গোপীমোহন দত্ত লেনের বাড়িতে। হঠাৎই সেই বাড়িতে পা পড়ল পুলিশের। বন্দুক, বোমা বাজেয়াপ্ত তো হলই; সেইসঙ্গে গ্রেফতার হলেন কানাইলাল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত-সহ আরও বেশ কিছু বিপ্লবীরা। শুরু হল বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলা…
আলিপুর জেলে বন্দিদশা কাটাতে গিয়ে বিপ্লবীদের নজরে পড়ে আরও একটা জিনিস। যার মূল কেন্দ্রে ছিলেন নরেন্দ্রনাথ গোঁসাই। শ্রীরামপুরের এক জমিদার বাড়ির ছেলে ইনি। ছোটো থেকেই ধন-দৌলতের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন, কিন্তু ভেতরে বিপ্লবী হওয়ার জন্য যে সাহস আর ত্যাগ দরকার, তার বিন্দুমাত্র ছিল না। নিতান্ত খেয়ালবশেই যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের সঙ্গে। পুলিশ গ্রেফতার করার পর ‘শখ’ পালিয়ে গেল। তখন তাঁর ভয়; যদি পুলিশ কিছু করে ফেলে! বাবার পরামর্শে নরেন গোঁসাই ঠিক করলেন, ব্রিটিশদের হয়ে রাজসাক্ষী দেবেন তিনি। পুলিশ তো মহাখুশি। নরেনও একটু একটু করে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বলতে থাকে তাঁদের…
জেলের ভেতর এই খবরটা চাপা থাকেনি। দেওয়ালেরও যে কান থাকে! বিপ্লবীরা ঠিকই খবর পেয়ে গেলেন; সেইসঙ্গে চিন্তিতও হয়ে পড়লেন। এবার উপায়? নরেন যে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, ভাবেননি কেউ। কিন্তু এখন উপায়? দুটো রাস্তা ঠিক হয়— প্রথম, জেল থেকে কয়েকজন বিপ্লবী পালাবেন। আর দ্বিতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নরেন গোঁসাইকে কিছুতেই জীবিত রাখা যায় না।
এমন সময় এগিয়ে এলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। নরেনকে হত্যা করার দায়িত্ব তিনি নিতে চান। হেমচন্দ্র দাসকে সেই কথাটা বলার পর রাজি হলেন সবাই। আলিপুর জেলের ভেতর থেকে কৌশলে বাইরে থেকে বন্দুক আনার ব্যবস্থা করা হল। সেইসঙ্গে সত্যেন সোজা চলে গেলেন নরেন গোঁসাইয়ের কাছে। বানিয়ে বানিয়ে বললেন যে, তিনিও রাজসাক্ষী হতে চান। নরেনও ইশারা বুঝে নিলেন। ব্রিটিশ পুলিশকে এই সংবাদ দিতে দেরি করেননি আর। তাঁরাও খুশি, আরও এক বিপ্লবী রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়েছে। কেউ বুঝতে পারল না, এসবই ছিল পরিকল্পনার অংশ। নরেন নির্ভয়ভাবে সমস্ত কিছু বলতে লাগলেন সত্যেনকে; আর তিনিও অন্য বিপ্লবীদের সেই খবর পৌঁছে দিতে লাগলেন…
শোনা গেল, ১ সেপ্টেম্বর পুলিশের কাছ জবানবন্দী দেবেন নরেন গোঁসাই। তার আগেই খতম করতে হবে বিশ্বাসঘাতককে। সত্যেনের ভেতরে রক্ত যেন ফুটছে। পিস্তল কাপড়ে মুড়ে কানাইলালের হাতে দিলেন হেমচন্দ্র। সত্যেনকে দিতে হবে এই জিনিসটি। সন্দেহ হতে সত্যেনের কাছে গিয়ে পুরো ব্যাপারটা জানলেন কানাইলাল দত্ত। তাঁরও মাথায় খুন চেপে গেল। এভাবে অপমান করল ও দেশবাসীকে। এরপর তো কিছুতেই বাঁচতে দেওয়া যায় না। সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে দলে ঢুকে গেলেন কানাইলালও। জানেন এর পরিণতি কী হবে, কিন্তু সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতেই চান না তাঁরা…
১৯০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। হিগিনস নামের এক কারারক্ষীকে নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথের কাছে এলেন নরেন গোঁসাই। পাশে বসার পর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। গল্প করতে করতে জামার পকেটে রাখা পিস্তলটার ট্রিগারে চাপ দিলেন সত্যেন। সঙ্গে সঙ্গে গুলির আওয়াজ! হিগিনস দৌড়ে এসে দেখল, মাটিতে পড়ে আছে নরেন; তাঁর উরুতে গুলি লেগেছে। আর পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। হিগিনসের দিকেও তাক করা হল বন্দুক। সেও আহত হয়ে পালিয়ে গেল। ইতিমধ্যে আরেকটা পিস্তল হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন কানাইলাল দত্ত। আলিপুর জেলের ভেতর নরেন গোঁসাইকে লক্ষ্য করে দুজনে শুরু করলেন গুলিবর্ষণ। রক্তে ভেজা শরীরটা ছিটকে গিয়ে পড়ল ড্রেনে। শেষ গুলিটা সেখানে গিয়ে তাঁর শরীরে বিঁধিয়ে দিলেন কানাইলাল। শেষ হল প্রতিশোধ। বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি সম্পূর্ণ…
গ্রেফতার হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু-কানাইলাল দত্ত। বিচার কী হবে, জানা ছিল সবার। ১০ নভেম্বর ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের প্রতি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন কটাক্ষ। মরতে ভয় পান নাকি কানাইলাল! এমনকি আইনি সাহায্যও নেননি। উচ্চতর আদালতে আবেদনের প্রসঙ্গ তোলা হলে বলেছিলেন, ‘দেয়ার শ্যাল বি নো অ্যাপিল’। পরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, যাওয়ার আগে Shall আর Will-এর ব্যবহারটা কানাই বুঝিয়ে দিয়ে গেল!
তথ্যসূত্র-
১) ‘কলকাতা বিচিত্রা’/ রাধারমণ রায়
২) ‘চিতাভস্ম কিনতে হুড়োহুড়ি’, শুভাশিস চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘কানাইলাল দত্ত’, সব বাংলায়
৪) ‘এই বাঙালি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘Don’t blacken my face’’, এই মুহূর্তে
Powered by Froala Editor