মর্ত্যে কৃষিকাজের ‘শুরু’ শিবের হাতে, মাছচাষের আগে পূজা পান মাকাল ঠাকুর

ধ্যানমগ্ন যোগী মহাদেবের মূর্তিটিকে আপামর ভারতবর্ষের মানুষ তো কবেই নিজের করে নিয়েছেন। ভারতবর্ষের প্রাচীনতম দেবতাদের একজন শিব। সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত পশুপতি মূর্তিটি থেকেই শিবের বিবর্তন বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। বিবর্তন ঘটেছে বহু ধারায়। তার সঙ্গে বৈচিত্র্যও তো কিছু কম নয়। মানুষ তার জীবনযাত্রার সঙ্গে এক করে নিয়েছেন এই দেবতাকে। ভারতবাসীর জীবনের নানান বৈচিত্র্যই তাই ফুটে ওঠে এই দেবতাকে ঘিরে।

বাংলাদেশে একসময় শৈব সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। পরে, মূলত গুপ্ত যুগ থেকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে তাঁরা কিছুটা পিছু হটেন। তবে বাঙালির লোকজীবনে বিশেষ ছাপ রেখে গেছেন তাঁরা। শিবকে নিয়ে নানান লোককথার জন্ম দিয়েছে বাঙালি। পার্বতী যেন বাঙালির নিজের কন্যা, আর শিব তাই জামাই। জামাই মানে এক অর্থে তার উপরেই পরিবারের স্বাচ্ছল্যের অনেকটা নির্ভর করে যায়। অথচ শিব জাত ভিখারি। শ্মশানে মশানে ছাই মেখে ঘুরে বেড়ায়। এভাবেই শিবের ছবি এঁকেছে বাঙালি। আর এই শিবের হাতেই নাকি মর্ত্যের চাষাবাদের গোড়াপত্তন। সেই কাহিনি উঠে আসে শিবায়নের অনেক পালাতেই।

আরও পড়ুন
বাংলার জামাই তিনি, ভোজনরসিক ও নেশায় ব্যোম – ‘ভুঁড়িওয়ালা’ শিবকে এভাবেই আপন করেছি আমরা

শিব তাই কৃষিকাজের দেবতা। বলা ভালো, দেবতা নিজেও চাষি। সেই চাষি শিবের কাহিনি নিয়েই রচিত হয়েছে অসংখ্য পালাগান। আজও দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামে সেসব গান শুনতে পাওয়া যায়। কৃষিকাজের দেবতা হিসাবে পূজিত হন শিব।

এইসব গান সাধারণত মনসামঙ্গলের কাহিনির দেবখণ্ডে গাওয়া হয়। আবার কোথাও কোথাও শিবের চাষের স্বতন্ত্র পালাও গাওয়া হয়। মনসামঙ্গল গাওয়ার সময় প্রায় সব গায়কই এই কাহিনির অবতারণা করেন। এইসব চারণ কবিদের কথায় কথায় লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে কাহিনি। আবার তার মধ্যে বৈচিত্রের ছোঁয়াও প্রচুর।

"শুন শুন মর্ত্যবাসী শুন দিয়া মন,
ধান্য সৃজন করিলাম অন্নের কারণ।
এই ধান্য তোমাদের আহার জুটিবে,
কৃষি দেবতা রূপে তোমরা আমায় পুজিবে।"

এভাবেই শুরু হয় গানের কাহিনিপাঠ। মর্ত্যলোকে কৃষিকাজের সূত্রপাত ঘটে আসলে বিশ্বাসী কবির কল্পনায়। এভাবেই তো মানুষের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল ধর্ম। বলা ভালো, আজও আছে। মানুষ তার নিজের জীবিকার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চেয়েছেন দেবতাকে।

আরও পড়ুন
হাইকোর্ট চত্বরে অধিষ্ঠান তাঁর, ভক্তদের জন্য সদা জাগ্রত ‘হাইকোর্টেশ্বর’ শিব

কৃষিকাজ বলতে শুধু ধানের চাষ কেন, দক্ষিণবঙ্গের জলা-জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলে মাছ চাষের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে শিব পূজার পদ্ধতি। দেবতার নাম এখানে 'মাকাল'। শব্দটি আসলে মহাকাল শব্দেরই অপভ্রংশ। মৎস্যজীবী সম্প্রদায় মূর্তিহীন মাটির থানকে মাকাল ঠাকুর বলে পুজো করে। অনেক জায়গায় সরল গঠনের কিছু আবক্ষ মূর্তিও থাকে। পুকুরের জল সেঁচে মাছ চাষ করার আগে মাকাল ঠাকুরের পুজো দেওয়ার রীতি অনেক পুরনো। পুজো বলতে তেমন বিরাট কিছু আয়োজন নয়। রেকাবি বা শালপাতা অথবা কাগজের ঠোঙায় সামান্য বাতাসা। কোথাও কোথাও তার সঙ্গে কিছু ফলমূল এবং চিনির সন্দেশ। এমনকি পুজো করতে লাগে না কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিতও। মাছচাষিরা নিজেরাই খড় জ্বালিয়ে পুজো করে মাকাল ঠাকুরকে। মাকাল ঠাকুরের সঙ্গে পালাগানের চাষি শিবের অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। প্রচলিত গানের কথায় দেখা যায় মহাদেব এবং গৌরী দেবী নিজেরা ধানক্ষেত সেচন করে মাছচাষ করেন। আবার নিজেরাই সেই মাছ মাথায় করে বিক্রি করতে যান। এভাবেই লোকজীবনের সঙ্গে মিলে মিশে যায় দেবতাদের কাহিনি।

আরও পড়ুন
দুর্গার সঙ্গে মর্ত্যে আসেন শিবও, দিন কাটান মেদিনীপুরের এই ‘শ্বশুরবাড়ি’-তে

পালাগানে দেবতাকে শুধু চাষি হিসাবেই উপস্থাপন করা হয় না। সেইসঙ্গে উন্নত চাষের জন্য, ভালো ফসল পেতে কী ধরনের পদ্ধতি নিতে হবে, সেইসব নির্দেশও দেওয়া থাকে। সংসারের অভাবে দারিদ্রে জর্জরিত মহাদেব এভাবেই নিজেদের পরিবারের একজন হয়ে ওঠেন। পুরাণের ধ্যানমগ্ন যোগী মহাদেব যেমন থাকবে, তেমনই থেকে যাবে লৌকিক পালার এই কাহিনিগুলো। ভুড়িওয়ালা, চাষি শিবের এইসব কাহিনি। দেবতা যেখানে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছেন। এভাবেই এগিয়ে চলে ইতিহাস…

তথ্যসূত্র:
চব্বিশ পরগণার লৌকিক দেবদেবী : পালাগান ও লোকসংস্কৃতি জিজ্ঞাসা, ড.দেবব্রত নস্কর
বাঙলা সাহিত্য পরিচয়, তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More