৩১০ বছর আগে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে উদ্ধার কোটি কোটি টাকার ধনসম্পত্তি

কথায় বলে, সমুদ্র সবকিছুই ফিরিয়ে দেয়। ফিরিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া রহস্যও। সেরকমই একটা রহস্যের নাম, ‘সান জোসে’, একটি শতাব্দী প্রাচীন স্প্যানিশ যুদ্ধ জাহাজ।

রহস্য গাঢ় হয়, যখন ২০১৫ সালে প্রায় ৩১০ বছরের পুরনো একটি মণিমাণিক্য পূর্ণ যুদ্ধজাহাজ খুঁজে পাওয়া যায় কলম্বিয়ার কার্টেজেনা সমুদ্র উপকূলে। সান জোসে নামের বিশাল এই জাহাজটিকে ১৭০৮ সালে একটি ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ধ্বংস হয়ে যায়। বিশাল পরিমাণে মূল্যবান সোনা, রুপো এবং রত্ন নিয়ে পাড়ি দিচ্ছিল জাহাজটি। স্প্যানিশ জাহাজ সান জোসের সঙ্গেই সমুদ্রের তলায় চলে যায় সেই অমূল্য সম্পদ। কিন্তু কীভাবে ধ্বংস হয় জাহাজটি? রহস্য সেই নিয়েই।

প্রায় ১৭০ কোটি টাকার সম্পত্তি আজীবনের মতো সমুদ্রের তলায় চলে যাওয়ার পর, কখনোই ভাবা যায়নি আর উদ্ধার করা সম্ভব হবে সেগুলিকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে এগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা হলেও প্রতিবারই ব্যর্থ হতে হয়েছে অনুসন্ধানকারী দলকে। অবশেষে ২০১৫ সালে উডস হোল ওসেনোগ্রফিক ইনস্টিটিউশনের একজন বৈজ্ঞানিক এবং অনুসন্ধানকারী জেফ কেলি ঘোষণা করেন, তিনি ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের নিচে চিহ্নিত করতে পেরেছেন সেই হারিয়ে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি। এগুলিকে তিনি ‘ভাঙা জাহাজের পবিত্র সম্পদ’ (দ্য হোলি গ্রেইল অফ শিপরেকস্) বলে অভিহিত করেছিলেন।

এই উদ্ধার অভিযানে ব্যবহার করা হয়েছিল রোবট সাবমেরিন ‘রিমাস ৬০০০’, যা সমুদ্রের নিচে প্রায় চার মাইল পর্যন্ত ডুব দিতে পারে। অত্যাধুনিক সেন্সর এবং ক্যামেরার সুবিধা নিয়ে এই সাবমেরিন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দু’হাজার ফিট নিচে খুঁজে পায় প্রাচীন এই জাহাজটি ভগ্নাবশেষ। বিপুল ধন-সম্পদ ছাড়াও জাহাজটির ভিতর থেকে পাওয়া গিয়েছে চা পান করবার কাপ এবং সেরামিক পাত্র। যদিও কেলি জানাতে ভোলেননি যে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া কিছুতেই এই উদ্ধারকার্যে সম্ভব হত না।

আরও পড়ুন
সমুদ্রের নিচে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে উঠে এল কঙ্কাল, অবস্থা থেকে চমক গবেষকদের

সমস্ত সম্পদের আর্থিক মূল্য কত? কেলির কথায়, যে কোনও প্রাচীন সম্পদ উদ্ধারের পরে সকলেই তার আর্থিক মূল্য বিচার করতে বসে। কিন্তু তার যে অমূল্য সাংস্কৃতিক মূল্য, সেটার দিকে একটুও নজর রাখে না কেউ। ‘সাংস্কৃতিক সম্পদ’ হিসেবে এই ধনরত্নের মূল্য যে অপরিসীম, তা পরিষ্কার করেছিলেন কেলি। বলেছিলেন যে, “যেন এক টুকরো ইতিহাস বসে আছে তোমার চোখের সামনে। একটা গল্প শোনানোর জন্য উন্মুখ হয়ে আছে যেন সেটা!”

আরও পড়ুন
সমুদ্রে দাঁড়িয়ে সংক্রমিত জাহাজ, মৃত অধিকাংশ যাত্রী, কোয়ারেন্টাইনের শুরু সেখানেই

যদিও আবিষ্কারের পর থেকেই কলম্বিয়া এবং স্পেনের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে এই সম্পদের মালিকানা দাবি করে। তবে উডস হোলের গবেষকরা বলেছেন, তাঁরা শুধুই অনুসন্ধানকারী; কখনোই মালিকানা চাওয়া তাঁদের কাজ নয়।

আরও পড়ুন
জাহাজ তাঁকে চিনিয়েছে পৃথিবী, কবিতা দিয়েছে ভাষা - এক বাঙালি নাবিকের গল্প

সান জোসে জাহাজটি ১৭০৮ সালের মে মাসের শেষদিকে পানামার বন্দর নগরী পোর্টোবেলো থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। এই সমস্ত সম্পত্তি যাচ্ছিল স্পেনের রাজা পঞ্চম ফিলিপের কাছে, যিনি যুদ্ধের জন্য অর্থ যোগাড় করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। সান জোসে জাহাজের ক্যাপ্টেন হোসে ফার্নান্দেজ ডি স্যান্তিলান জানতেন, ব্রিটিশরা কার্টেজেনা শহরের কাছাকাছি আক্রমণ করার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে। সেই আশঙ্কাই সত্যি হয় তাঁর।

পরবর্তী কালে, কার্টেজেনার ক্যারিবিয়ান সামুদ্রিক জাদুঘরের কিউরেটর গনজালো জুনিগা প্রকাশ করেছিলেন, কীভাবে ক্যাপ্টেন ফার্নান্দেজ জাহাজের বাকিদের একত্রিত করে ছুরি, তলোয়ার এবং পিস্তল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন লড়াই করতে। কিন্তু সেই যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদের পরাস্ত করতে না পারলেও, ব্রিটিশরাই জাহাজটি ধ্বংস করেছিল কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান জুনিগা। তাঁর মতে, হয়তো আত্মসমর্পণ এবং খালি হাতে স্পেনে ফিরে আসার পরিবর্তে, ক্যাপ্টেন জাহাজটিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সলিল সমাধির পথই বেছে নেন। ধনসম্পদ উদ্ধার হলেও, সান জোসের ধ্বংসের আসল রহস্য তাই হয়তো উদ্ধার হয়নি কয়েক শতাব্দী পেরিয়েও।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More