৪ বাঙালির চারটি ব্যাঙ্ক মিলে তৈরি ইউবিআই, হারিয়ে গেল সেই অস্তিত্বও

ভারতের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এসে মিশেছে আরও কত কিছু! সেখানে যেমন আছে মানুষরা, তেমনই রয়েছে নানা প্রতিষ্ঠান। এই ইতিহাসের অন্যতম অংশীদার ব্যাঙ্কগুলি। দেশের লক্ষ্মীর ভাঁড়ারদের নিজেদের ইতিহাসও কম আকর্ষণীয় নয়। সেই গল্পে মিশে আছে ছোটো বড়ো নানান সংস্থা। সাম্প্রতিক প্রস্তাবনা অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি একে অপরের সঙ্গে মিশে যাবে। এর ফলে বেশ কিছু ব্যাঙ্কের অস্তিত্ব শুধু নামেই থাকবে। সেরকমই একটি ব্যাঙ্ক হল ইউবিআই, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। ১ এপ্রিল এই ব্যাঙ্কটি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশে গেল পুরোপুরি।

আরও পড়ুন
বাড়িতেই পৌঁছে দেওয়া হবে টাকা, লকডাউনে আপৎকালীন পরিষেবা ব্যাঙ্কগুলির

খানিক পেছনে ফেরা যাক। নামে ‘ইন্ডিয়া’; কিন্তু সূচনা লগ্ন থেকে ছিল আদ্যোপান্ত বাংলার ছোঁয়া। ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া যে আসলে এখানকারই ব্যাঙ্ক! কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর অস্তিত্ব ছিল না। সময়টা বিংশ শতক। বাংলায় রমরমিয়ে বিরাজ করছে চারটি ব্যাঙ্ক। কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন, বেঙ্গল সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, হুগলি ব্যাঙ্ক ও কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। চারটে ব্যাঙ্কেরই প্রতিষ্ঠাতা বাঙালি। প্রধান কেন্দ্রও ছিল বাংলায়। সবথেকে পুরনো ছিল কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন। ১৯১৪ সালে নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত তৈরি করেছিলেন এই ব্যাঙ্ক। চার হাজার টাকা দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। আস্তে আস্তে শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। নরেন্দ্র দত্তের নজর পড়েছিল চা বাগানগুলোর দিকে। সেখান থেকেই চা শিল্পে আমানতকারীদের লোন দেওয়া থেকে শুরু করে সেখানকার যাবতীয় কাজের দায়িত্ব নেয় এই ব্যাঙ্ক। নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত পরে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

আরও পড়ুন
ইতালীয় স্থাপত্যের ছোঁয়া সর্বত্র, কলকাতার এই বাড়িতেই ছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রধান কার্যালয়

বেঙ্গল সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের জন্মও প্রায় কাছাকাছি সময়। জে সি দাস নামের এক ব্যক্তি ১৯১৮ সালে তৈরি করেন এই প্রতিষ্ঠান। কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের সৃষ্টির মূলে ছিলেন একজন আইএএস অফিসার, ইন্দুভূষণ দত্ত। ১৯৩২ সালে তৈরি হুগলি ব্যাঙ্কের রূপকার ছিলেন ডি এন মুখার্জি। দিব্যি চলছিল সবটা। তখনও স্বাধীনতা আসতে ঢের দেরি। অন্যান্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে একরকমভাবে চলছিল এরাও।

আরও পড়ুন
ইয়েস ব্যাঙ্কের অবস্থা সঙ্গীন, টাকা তোলার সীমা বেঁধে দিল আরবিআই

অবশেষে এল ১৯৪৭। ভারত স্বাধীন হল। সেই সঙ্গে হল দেশভাগও। বাংলার এই চারটে ব্যাঙ্ক পড়ল মুশকিলে। অনেক জায়গাতেই তো শাখা খোলা ছিল। কুমিল্লার ব্যাঙ্ক দুটোর সৃষ্টি ওপার বাংলায়। তখন তো বিদেশ হয়ে গেছে সব। এবার কী করণীয়? সেই সময় প্রস্তাব এল এদের এক হয়ে যাওয়ার। সেটা হলও। ১৯৫০ সালের ডিসেম্বরে একসঙ্গে মিশে গেল ওই চারটি ব্যাঙ্ক। তৈরি হল ‘ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’। ট্যাগলাইনও বাছা হয়ে গেল। অবশ্য নামের মধ্যেই তো ছিল সেই সম্ভাবনা। ‘দ্য ব্যাঙ্ক দ্যাট বিগিনস উইথ ইউ’।

আরও পড়ুন
ভাঙনেও ফুরোয়নি স্মৃতি, স্থানের নামেই বেঁচে আছে ধর্মতলার ‘চ্যাপলিন’

গোটা ভারতে এদের দুই হাজারের ওপর শাখা থাকলেও, সবথেকে বেশি প্রাধান্য ছিল বাংলাতেই। এখান থেকেই যে পথ চলা শুরু হয়েছিল। বলা ভালো, বাঙালিদের হাতেই তো প্রাণ পেয়েছিল এটি। সদর কার্যালয়ও ছিল কলকাতায়। ৭০ বছরের যাত্রা অবশেষে খানিক ইতি টানল। গত বছর ভারতের অর্থ মন্ত্রকের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২০-এর ১ এপ্রিল থেকে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া মিশে যাবে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সঙ্গে। দেখতে দেখতে সেই দিনটিও চলে এল। কত পুরনো ইতিহাস, পুরনো কাহিনি। যার সঙ্গে সম্পূর্ণটা দিয়ে জড়িয়ে ছিল এই বাংলাও। অবশেষে, সেই পথ চলা থামল।