‘লোহার ফুসফুস’ থেকে আজকের ভেন্টিলেটর, যে বিজ্ঞান মানুষকে বাঁচিয়েছে বারবার

রোগীর সংকটজনক অবস্থা, শ্বাস নিতে পারছেন না। হয়তো দেখা গেল, আগে থেকেই শ্বাসজনিত সমস্যা ছিল তাঁর। যাই হোক না কেন, একটা সময় ঠিক উঠে আসবে একটি নির্দিষ্ট যন্ত্রের নাম। যেটা সামনে এলেই অনেক বাড়িতে একটাই কথা ভেসে আসে, ‘এবার বোধহয় আর বাঁচানো গেল না।’ ডাক্তার থেকে সংবাদমাধ্যম, সমস্ত জায়গায় এই একটি যন্ত্রের নাম শোনা যাবেই। এখনও বোঝা যাচ্ছে না? আমাদের চিরপরিচিত ‘ভেন্টিলেটর’।

অবশ্য নামটি শুনলেই যে আমাদের বুক কেঁপে ওঠে, তেমনটি নয় কিন্তু। আমাদের বাড়িতে দেওয়ালের গায়ে গর্ত করে ঘুলঘুলি তৈরি করা হয়; যাতে হাওয়া চলাচল করতে পারে ভালোভাবে। ভেন্টিলেটর মেশিনের কাজও সেইরকমই। যাঁদেরই শ্বাসজনিত কোনো সমস্যা থাকে, বা দেখা গেল হঠাৎ করে রোগী ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না, তখনই এটি ব্যবহার করা হয়। বলা ভালো, কৃত্রিম একটি ফুসফুসের কাজই করে এটি। অবস্থা সংকট হলেও তাই এটিকে ব্যবহার করা হয়। তবে এ তো গেল কাজ ও অন্যান্য বৃত্তান্ত। আজকে হাসপাতালে গেলে যে ভেন্টিলেটর মেশিন দেখা যায়, সেগুলি আধুনিক। কিন্তু একটা সময় তো এরকম ছিল না! মেকানিকাল থেকে ডিজিটাল— এই যাত্রা এগিয়েছে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

ষোড়শ শতাব্দীতে আন্দ্রেস ভেসালিয়াস নামে ব্রাসেলসের এক অ্যানাটমির অধ্যাপক প্রথম ভেন্টিলেশনের কথা বলেন। ‘দে হুমানি করপলিস ফাব্রিকা’ বইটিতে উল্লেখ করেন পজিটিভ ভেন্টিলেশনের কথা। ইতিহাসে সেটাই ছিল সর্বপ্রথম উল্লেখ। তবে ভেন্টিলেটরের ইতিহাস বলতে গেলে আরও একটি নাম সামনে আসবে। ‘আয়রন লাং’, বাংলায় বললে লোহার ফুসফুস। মেকানিকাল রেসপিরেটর যন্ত্রের প্রথম দিককার একটি মডেল। বিশাল বড়ো লোহার খাঁচাটাকে দেখলে আজকের ছিমছাম ভেন্টিলেটর রূপটিকে কল্পনা করা খানিক মুশকিলই হবে। ডাক্তারি পরিভাষায় এটি ‘নেগেটিভ প্রেশার ভেন্টিলেটর’। ১৮৩২ সালে সবার প্রথমে এমন ভেন্টিলেটরের কথা সামনে আনেন স্কটিশ ডাক্তার জন ডালজিয়েল। কৃত্রিমভাবে ফুসফুসের ওপর চাপ তৈরি করে তার কার্যক্ষমতাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা, এটাই ছিল আসল লক্ষ্য। মূলত পোলিও-র চিকিৎসায় এর ব্যবহার করা হত।

তিরিশের দশকে এক এক করে ভেন্টিলেটর তৈরি হতে থাকে। তবে তারও আগে, ১৮৫৪ সালে প্রথমবার জনসমক্ষে মেকানিকাল ভেন্টিলেশন সিস্টেমকে আনা হয়। লিভারপুলের সেন্ট জর্জ হলের বিশাল কক্ষে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে সেটা ডাক্তারি ব্যবহারে ছিল না। সেটা শুরু হয় ১৯৩০-এর পর থেকে। তখন ভেন্টিলেটরের বদলে বেশি প্রচলিত ছিল ‘রেসপিরেটর’ শব্দটি। আর সাইজও ছিল আয়রন লাং মেশিনের মতোই।

১৯৫০-এর পর সিস্টেম আরেকটু উন্নত হল। আয়রন লাং-এর যন্ত্রগুলির কাজের পদ্ধতির থেকে এগুলি যেন আলাদা। অত বড়ো নয়, আকৃতি খানিক ছোটো হল। তার থেকেও বড়ো কথা, এই প্রথম ব্যবহার করা হল মাস্কের। নেগেটিভ প্রেশারের পরিবর্তে পজিটিভ প্রেশার দেওয়া হল। মানে, মাস্কের মাধ্যমেই কৃত্রিমভাবে পরিমাণ মতো অক্সিজেন যুক্ত বিশুদ্ধ বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করানো হয়। তারপর নিঃশ্বাসও বের করে দেওয়া হয়। এই পুরো ব্যাপারটাই হয় অক্সিজেন সিলিন্ডার, নয়তো স্রেফ হাতে করে ব্লাডারের সাহায্যে (রাবারের বড়ো বেলুনের মতো জিনিস)।

সেদিনের সেই মেকানিকাল ভেন্টিলেটর আজ আমূল বদলে গেছে। ইলেকট্রনিক সিস্টেমেও একের পর এক উন্নতি হয়ে চলেছে। আজ আর শুধু ভেন্টিলেটর মেশিন নেই, অনেক জায়গায় একইসঙ্গে অ্যানাস্থেশিয়ার কাজও করা সম্ভব সেখানে। প্রতিটা হাসপাতালের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে এই ভেন্টিলেটর। কত মানুষের শেষ মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। আতঙ্ক নয়, সেখানে আছে ভরসার হাত!