মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধে বন্দি বারাসতের শঙ্কর চক্রবর্তী, মুক্তি পান আকবরের স্ত্রী-র অনুরোধে

সময়টা উনবিংশ শতক। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ গোটা বাংলা। একে একে বিদ্রোহ আগুন জাগছে চাষিদের মধ্যে। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে চব্বিশ পরগণার ছোটো ছোটো গ্রামগুলিতেও। সেই সময়ই উঠে এলেন এক ব্যক্তি, নাম সৈয়দ মীর নিশার আলি। সকলেরই অপছন্দের তেতো ওষুধ অনায়াসে খেয়ে ফেলতেন বলে ছোটোবেলায় নাম হয়ে গিয়েছিল ‘তিতু’। সেখান থেকেই ‘তিতুমির’। ইংরেজ নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। শুরু করেছিলেন গণবিদ্রোহ। বারাসত দেখেছিল, সাহেবদের ঠেকাতে তাদের তিতু তৈরি করেছে বাঁশের কেল্লা। যুদ্ধটা অসম; কিন্তু প্রতিরোধের, প্রতিবাদের উদ্যোগ যে সব জায়গায় থেকেই করা যায়, সেটাই তুলে ধরে বারাসত।

শুধু বর্তমান সময়ই নয়, ইতিহাসের পাতায় নানা সময় নানা ভাবে উঠে এসেছে বারাসতের প্রসঙ্গ। শিয়ালদহ থেকে ২২ কিমি দূরের এই জনপদটি একসময় ছিল ব্রিটিশ কর্তাদের সাপ্তাহিক বিশ্রামের জায়গা। মনোরঞ্জনের জন্য কালে কালে তৈরি হল বাগানবাড়ি। আর বাকিটা ছিল বড় বড় গাছ, জঙ্গলে ভরা। আর এই সবুজের প্রেমেই পড়েন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। বারাসতের হাতিপুকুর অঞ্চলে তৈরি করেন নিজের দোতলা বাড়ি। আজও টিকে আছে হেস্টিংসের সেই বাড়ি।

আরও পড়ুন
রং-তুলির সাহায্যে ক্যানভাস হয়ে উঠল গোটা গ্রাম, বাংলার ‘খোয়াব গাঁ’-এর গল্প

বারাসত নামের ইতিহাস নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সবচেয়ে প্রচলিত মত হল দুটি। বলা হয়, বাংলার প্রখ্যাত জগৎশেঠের পরিবারের বারোজন সদস্যের বসবাসের জায়গা ছিল এই জনপদ। সেখান থেকেই ‘বারাসত’, যা অনেকে ‘বারোশেঠ’-এর অপভ্রংশ বলেও মনে করেন। বারাসতে আজও যে শেঠপুকুরটি রয়েছে, সেটিও তৈরি করেন এই জগৎশেঠদেরই একজন, রামচন্দ্র জগৎশেঠ। এছাড়াও নামকরণের আরেকটা কাহিনিও প্রচলিত। এক সময় মোট সাতটি জনপদ নিয়ে তৈরি হয় এই গোটা অঞ্চল। সেখান থেকেই ষোড়শ শতকে এই নামটি তৈরি হয়। ‘বারাসত’-এর ‘বার’-এর ফার্সি অর্থ হল জনপদ; আর ‘সত’ হল সাতেরই অপভ্রংশ।

নামকরণ যাই হোক, দুটো কাহিনি এটাই প্রমাণ করে ইতিহাসের পাতায় এর অস্তিত্ব শুধু ইংরেজ আমল থেকেই শুরু হয়নি। বারাসত তো বটেই, এর আশেপাশের বেশ কিছু অঞ্চলে গুপ্ত, বৌদ্ধ যুগের অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। ‘আইন-ই-আকবরি’ থেকে জানা যায়, আকবর ও মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ও তাঁর সেনাপতি শঙ্কর চক্রবর্তীকে বন্দি করে আগ্রায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু যোধাবাঈয়ের বিশেষ অনুরোধে শঙ্করকে ছেড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু মুক্তি পাননি প্রতাপাদিত্য। শঙ্করের বাসস্থান ছিল এই বারাসতেই। পরবর্তীকালে তিনি দুর্গাপুজো শুরু করেন, যা আজও সমানভাবে, নিয়ম মেনে করা হয়।

আরও পড়ুন
বাংলায় এখনও টিমটিম করে বেঁচে রয়েছে আমেরিকান এই এয়ারফিল্ড

এর পাশাপাশি রয়েছে কাজিপাড়ার হজরত একদিল শাহের মাজার। আঠেরো শতকে বারাসতে অনেক সমাজকল্যাণমূলক কাজ করেছিলেন ইনি। কাজিপাড়ার এই মাজার আজও এখানকার মুসলিমদের কাছে পবিত্র স্থান। তবে সমাজ সচেতনতার কাজ এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বেথুন সাহেবেরও আগে, এই বারাসতেই মেয়েদের স্কুল তৈরি করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচরণ সরকার, কালীকৃষ্ণ মিত্র।

ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে, বারাসত পরিচিত ছিল ‘ব্লু ডিসট্রিক্ট’ বা নীল জেলা। নাম শুনেই কারণটা কিছুটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। অত্যাধিক নীল চাষের জন্য এমন নাম। যেমন নীল চাষের আধিক্য, তেমনই অত্যাচারের বাড়বাড়ন্ত। পরে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বারাসতের রূপ বদল হয় কিছুটা। ১৮৬১-তে মহকুমা শহর হিসেবে একে চিহ্নিত করা হয়। তখনকার অনেক বই ও ম্যাপেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখান থেকে বারবার খোলস বদলের পর, আজকে উত্তর ২৪ পরগনার সদর শহর হিসেবে উঠে এসেছে বারাসত।

আরও পড়ুন
‘চা পানের উপকারিতা’ – ব্রিটিশ আমলের যে বিজ্ঞাপন আজও রয়েছে দমদম স্টেশনে

সময় বদলায়। বদল হয় চেহারারও। শুধু মানুষ নয়, একটা স্থানও বদলে যেতে থাকে সময়ের হাত ধরে। আর পুরনো সব দিনের কথা ঠাই পায় ইতিহাসে। সেদিনের কয়েকটা বাগানবাড়ি আর গাছগাছালিতে ঘেরা বারাসতে আজ তৈরি হয়েছে মাল্টিপ্লেক্স, মল, স্টেডিয়াম। তৈরি হয়েছে হাউজিং কমপ্লেক্স। কয়েকটি বাগানবাড়ির পরিবর্তে ছেয়ে গেছে অজস্র বাড়ি আর ফ্ল্যাটে। কিন্তু ইতিহাস তো এত সহজে ভোলার নয়। চাঁপাডালি, ডাকবাংলো, কলোনি মোড়ের বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একটা মফস্বলের নিজস্ব আওয়াজ। যেখানে জড়িয়ে থাকে ঐতিহ্য, হিংসা; জড়িয়ে থাকে সাহিত্য। বারাসতও সেসবের থেকে আলাদা নয়।

ঋণ-
১) ফুল ফল মফস্বল/ মৃদুল দাশগুপ্ত
২) রোর বাংলা

Powered by Froala Editor