দেশভাগ, একটি বাড়ি ও দেবীবন্দনা; কলেজ স্ট্রিটের অদূরেই অজানা ইতিহাস

ঠিক কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে হাওড়ার দিকে একটু এগোলেই কলাবাগান। বৈশিষ্ট্য বলতে তেমন কিছুই চোখে পড়ার নেই। এখানেই ডানদিকের গলি দিয়ে ঢুকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই একটি পুরনো বাড়ির মধ্যে জমজমাট পুজোর মেজাজ। তবে এই পুজোর সঙ্গেই যে জড়িয়ে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস, তার খবর আন্দাজ করা সত্যিই কঠিন। চারিদিকে ব্যস্ততা, করোনা পরিস্থিতিতে নানা দুশ্চিন্তা। অথচ এসবের মধ্যেও স্মৃতিচারণে বারবার বুঁদ হচ্ছিলেন পুজোর প্রবীণ উদ্যোক্তা উজ্জ্বল আইচ।

সেটা ১৯৪৮ সাল। সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। আর স্বাধীনতার সঙ্গী হয়ে এসেছে দেশভাগ। বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবি যেন এক ধাক্কায় ভেঙে পড়ল। পূর্ববঙ্গ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলায় আশ্রয় নিচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। কলাবাগান অঞ্চলের এই বাড়িটি ছিল পশ্চিম ভারত থেকে আসা এক ব্যবসায়ীর। তাঁর নাম পুরুষোত্তম দাস হালওয়াসিয়া। নিজের ব্যক্তিগত বাড়িকে তিনি তুলে দিলেন একটি নতুন ট্রাস্টির হাতে। বাড়ির প্রতিটি ঘর তুলে দেওয়া হল একেকটি পরিবারের হাতে। তবে বিনামূল্যে নয়। সামান্য ভাড়ার বিনিময়ে। কারোর দয়ায় তাঁরা সেখানে থাকছেন না, এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন পুরুষোত্তম দাস।

ছেলেবেলায় শোনা সেইসব কথা বলতে বলতে স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন উজ্জ্বল আইচ। হঠাৎ বলে ওঠেন, “জানেন, তখন এক একটা ছোট্ট ঘরে থাকত আস্ত একটা পরিবার। অবশ্য তা না হলে অত মানুষকে আশ্রয় দেওয়াও সম্ভব ছিল না। এই একটা বাড়িতেই এসে উঠেছিল প্রায় ১১০টি পরিবার।” অবশ্য ৮৮-বি মদনমোহন বর্মণ স্ট্রিটের এই বাড়িটায় এখন আর শতাধিক পরিবারের বাস নেই। পুরোন বাসিন্দারা অনেকেই পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এখান থেকে চলে গিয়েছেন। তবু উজ্জ্বলবাবুর মতো কেউ কেউ আজও ফিরে আসেন শুধুই পুজোর টানে। অবশ্য একথা বললে তিনি আপত্তি করেন। “ফিরে আসব কেন, এই বাড়িতে এখনও একটা ঘর আমি ভাড়া নিয়ে রেখে দিয়েছি। এটাই আমার বাড়ি।”

খাতায় কলমে এই পুজো সার্বজনীন পুজো। আয়োজক সংস্থার নাম ‘কলাবাগান কিশোর সংঘ’। তবে স্থানীয় মানুষদের কাছে এই পরিচয় জিজ্ঞেস করলে কিন্তু রাস্তা খুঁজে পাবেন না। অশোক মজুমদারের বাড়ির পুজো বললেই এক ডাকে দেখিয়ে দেবেন সকলে। পুজোর মেজাজও একেবারেই পারিবারিক পুজোর মতো। “আসলে এই একটা বাড়ির মধ্যে তো সবাই মিলে একটা পরিবার হয়েই আছি”, বলছিলেন অশোক মজুমদার। “আজকাল তো ক্লাব আর ফ্ল্যাটবাড়ির চাপে পারিবারিক পুজো হারিয়েই যাচ্ছে। আমরা তার কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।” বাড়ি পুরোন ভাড়াটিয়াদের অনেকেই উঠে গিয়েছেন। ৮০ শতাংশের বেশি সদস্যই নতুন। অশোকবাবুর মতো কেউ কেউ প্রায় ৫ দশক ধরে এই পুজোর দায়িত্ব সামলে যাচ্ছেন। এখন শুধু অপেক্ষায় আছেন কখন নতুন প্রজন্মের কেউ এসে কাঁধে দায়িত্ব তুলে নেবে।

আরও পড়ুন
আজ থেকে কলকাতার পথে ডবল-ডেকার বাস; কোথায় পাবেন এই পরিষেবা?

তবে নতুন সদস্যদের সবাই বাঙালি হিন্দু নন। আছেন মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা মানুষ। এমনকি একজন মুসলমান সদস্যও আছেন বাড়িতে। কিন্তু বাড়ির দুর্গাপুজো হয় উঠেছে সকলেরই। আশেপাশের বস্তিবাসী মুসলমানরাও দুর্গাপুজোর সময় রাস্তাঘাট পরিষ্কার করে দেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন প্রয়োজন মতো। বিসর্জনের শোভাযাত্রা যেন তাঁদেরকেও বুঝিয়ে দেয় একটা উৎসবের পরিসমাপ্তি। এবছর করোনা পরিস্থিতিতে অবশ্য বিসর্জনের শোভাযাত্রা বেরোবে না। শুধু ঢাকের আওয়াজই মনে করিয়ে দেবে বিগত ৭২ বছরের ইতিহাস। সেদিনের সেই দেশত্যাগী মানুষরা কি এই পুজোর মধ্যেই শিকড়ে মাটি খুঁজে পেয়েছিলেন? কে জানে...

Powered by Froala Editor

More From Author See More