ইউরোপিয় সুপার লিগ নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে, জাতীয় দল থেকেও নিষিদ্ধ হবেন খেলোয়াড়রা!

২০০৯ সালের কথা। চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য প্রকাশ করেছিলেন আর্সেনালের তৎকালীন কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার। ইউরোপের তাবড় ফুটবল ক্লাবগুলি নাকি গাঁটছড়া বাঁধছে উয়েফার বিরুদ্ধে। ক্লাব কর্তৃপক্ষরা পরিকল্পনা করছে এক স্বতন্ত্র লিগ চালু করার। তবে এমন মন্তব্য করায় বেশ বড়োসড় সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন স্বয়ং আর্সেন ওয়েঙ্গার। তখন কে-ই বা জানত এক দশক পরে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবে ইউরোপের ফুটবল-দুনিয়া? 

হ্যাঁ, সম্প্রতি ঘোষিত হল ইউরোপিয়ান সুপার লিগের কথা। আগামী মরশুম থেকেই আয়োজিত হতে চলেছে এই প্রতিযোগিতা। উয়েফার ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্রভাবে এই লিগ পরিচালনা করবে ইউরোপের প্রতাপশালী ১২টি দল। যার মধ্যে রয়েছে ইংল্যান্ডের ৬টি ক্লাব— ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, আর্সেনাল, লিভারপুল, চেলসি ও টটেনহাম। স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ, অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং ইতালির জুভেন্তাস ও দুই মিলানও সামিল হয়েছে এই সুপার লিগে। তবে জার্মান ও ফ্রেঞ্চ জায়েন্ট বায়ার্ন মিউনিখ ও পিএসজি প্রস্তাব পেলেও এখনও পর্যন্ত রাজি হয়নি এই লিগের অংশ হতে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, হঠাৎ কেন এই বিচ্ছেদের সুর? উত্তর, অর্থ। ২০২০ সালে মহামারীর কারণে ফুটবল থমকে যাওয়ার পরেই এই বাণিজ্যিক লিগের কথা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল হঠাৎ করেই। আর এক বছরের মধ্যেই বাস্তবায়িত হল তার নীল-নকশা। হিসেব বলছে এই লিগ আয়োজিত হলে প্রতিষ্ঠাতা ১২টি ক্লাবের ভাঁড়ারে ঢুকবে ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার। এ তো গেল শুধু আয়োজকদের কথা। তাছাড়াও কোনো দল সব কটি ম্যাচ হারলেও পাবে ১২ কোটি মার্কিন ডলার। চ্যাম্পিয়ন হলে সংখ্যাটা ২১.২ কোটি। 

হ্যাঁ, এক কথায় লাভের বন্যা। ১২টি প্রতিষ্ঠাতা ক্লাব ছাড়াও আরও ৩টি অতিথি ক্লাব অংশগ্রহণ করবে এই টুর্নামেন্টে। গোটা বছরের পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে যোগ্যতা অর্জন করবে আরও ৫টি ক্লাব। সব মিলিয়ে ২০টি ক্লাবের এই প্রতিযোগিতা। সুইস পদ্ধতিতে খেলা হবে লিগ ফর্ম্যাটে। তারপর কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি ফাইনাল ও ফাইনাল।

আরও পড়ুন
মিস করেননি একটিও ম্যাচ, সদ্যপ্রয়াত দম্পতিকে বিরল সম্মাননা তুর্কির ফুটবল ক্লাবের

তবে সুপার লিগের কথা ঘোষণার হওয়ার পরই দুই গোলার্ধে ভাগ হয়ে গেছে ফুটবল-জগৎ। একদিকে যেমন সাবেক ম্যান-ইউ কোচ অ্যালেক্স ফার্গুসন, প্রাক্তন লিভারপুল তারকা গ্যারি মার্ফি সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন এই সিদ্ধান্তকে; তেমনই রীতিমতো রণমূর্তি ধারণ করেছে ইউরোপের ফুটবল নিয়ামক সংস্থা উয়েফা। বিরোধিতায় সরব হয়েছেন ক্লাব সমর্থকরাও।

আরও পড়ুন
২০২২ পর্যন্ত অলিম্পিক এবং ফুটবল বিশ্বকাপ থেকে নির্বাসন রাশিয়ার

ইউরোপের সেরা ক্লাবগুলিকে নিয়ে হতে চলা এই টুর্নামেন্ট যে অভাবনীয় ফুটবল উপহার দেবে বিশ্বকে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে বিষয় হল, এই টুর্নামেন্টের জেরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে ইউরোপের অন্যান্য লিগ ও কাপগুলিতে। ‘তারকা’-শূন্য হয়ে পড়ায় এক ধাক্কায় কমে যাবে দর্শকদের ভিড়। টেলিভিশন চ্যানেলগুলিও কি আদৌ আগ্রহী হবে ব্রডকাস্টে? ফলত দু'দিক থেকেই কমবে আয়। তুলনামূলক ছোটো ক্লাবগুলির পক্ষেও দায় হয়ে দাঁড়াবে স্পনসর জোগাড় করা। শুধু বিভিন্ন দেশের টুর্নামেন্টই নয়, রীতিমতো মুখ থুবড়ে পড়বে উয়েফার লাভও। যার প্রভাব পড়বে সমগ্র ইউরোপীয় ফুটবলে। সাধারণত প্রতিটি প্রভাবশালী ক্লাবের থেকেই উপার্জনের একটি বড়ো অংশ গ্রহণ করে থাকে ফুটবল সংস্থাটি। আর সেই অর্থ বিভিন্ন ছোটো ক্লাবের উন্নয়নে ব্যবহার করে থাকে উয়েফা। সুপার লিগ হলে বন্ধ হয়ে যাবে সেই পথ। আর হতেও চলেছে তেমনটা। উয়েফাতে যে সুপার লিগের ১২টি প্রতিষ্ঠাতা ক্লাব অংশ নেবে না, তা তারা জানিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যেই।

আরও পড়ুন
ফুটবলের গ্যাংস্টার ও এক অন্ধকার শহরের কিসসা

অন্যদিকে সুপার লিগের বিরুদ্ধে কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে উয়েফা। জানানো হয়েছে, সুপার লিগ খেলা ক্লাবগুলি আর খেলতে পারবে না ইউরোপের কোনো লিগেই। পাশাপাশি সুপার লিগের সমস্ত খেলোয়াড়রা সুযোগ পাবেন না জাতীয় দলেও। খেলতে পারবেন না ইউরো কিংবা বিশ্বকাপ। এমনকি এমনটা বাস্তবায়িত করতে ৫০০ কোটি টাকার মামলা করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে উয়েফা। উয়েফার এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছে ফিফাও। এই ঘোষণার ফলাফল যে ঠিক কী হতে চলেছে, তা অনুমান করতে পারছেন না ক্রিড়া বিশেষজ্ঞরাও। রোনাল্ডো, মেসি, নেইমার, লিওনডক্সির মতো তারকা ফুটবলাররা কি দেশের স্কোয়াডে সামিল না হয়ে শুধু অর্থের জন্য খেলতে যাবেন সুপার লিগে? ঘুরে ফিরে আসছে এই প্রশ্নই। আর না খেলেই বা উপায় কি? ইউরোপের সাধারণ দলগুলির কি আদৌ সামর্থ্য রয়েছে ব্যাপক অর্থ দিয়ে এই ধরণের প্লেয়ারদের কিনে নেওয়া? কার্যত তাঁরাও যেন ধর্মসংকটে। 

সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর রদবদল হতে চলেছে ইউরোপীয় ফুটবলে। তবে এ-কথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই, উয়েফায় প্রথম সারির ক্লাবগুলির অনুপস্থিতি ইউরোপের জৌলুস কমিয়ে দেবে অনেকটাই। যেখানে লিপজিগ বা আটলান্টার মতো ছোট দলও পিএসজি, অ্যাথলেটিকোর মতো জায়েন্টদের কড়া চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল আগেরবারে। সেই ম্যাজিক হারিয়ে যাবে চিরতরে। যা নিঃসন্দেহে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বড়ো ক্ষতি। এখন দেখার, বাণিজ্যিকরণের এই যুদ্ধে শেষ হাসি ফুটে ওঠে কার ঠোঁটে…

Powered by Froala Editor