এটিকে-মোহনবাগান, এটি কি মোহনবাগান?

‘হাঁস ছিল সজারু/ ব্যাকরণ মানিনা
হয়ে গেল হাঁসজারু / কেমনে তা জানিনা।’

সুকুমার রায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।

যেমন ধরুন এক ছিল ১৩০ বছরের ঐতিহ্যবাহী, ময়দানে সাহেবদের খালি পায়ে হারানো ফুটবল ক্লাব। যাকে ঘিরে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় জাতীয়তাবোধের জোয়ারে ভেসেছিল আপামর ভারতবাসী।

আর একদিকে আছে মাত্র পাঁচ বছর আগে তৈরি হওয়া, বিস্তর টাকাকড়ি-সৌরভ-সঞ্জীব গোয়েঙ্কাদের রোশনাই খচিত কর্পোরেট ফুটবল ফ্র্যাঞ্চাইজি। এমনিতেই তেলে জলে মিশ খায় না। হাঁস আর সজারুতে তো নয়ই। কিন্ত দুই-এ মিলে, এই বছরেই জন্ম নিতে চলেছে 'হাঁসজারু'। এ-টি-কে-মোহনবাগান। এর ফলে আসলে যা হল, তা কিন্ত না 'এ-টি-কে', না মোহনবাগান। একেবারেই নতুন চিজ।

অনেকেই বলছেন, এই সংযুক্তিকরণ ঐতিহাসিক। তাঁরা ঠিকই বলছেন। হয়তো এই মিলনের মাধ্যমে সূচনা হবে নতুন ভোরের। কিন্ত আরো একটি কারণেও এমন পদক্ষেপ ঐতিহাসিক। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো ফুটবল ক্লাবটির অচিরে মৃত্যুও হল।

এটুকু পড়েই চটে যাবেন না। একটু যুক্তি দিয়ে ভাবুন।

আমার মেজকা তো কট্টর মোহনবাগানি। আজ টেবিল চাপড়ে বলছিলেন, "দুঃখ করিসনি! আরে মোহনবাগান নামটা অন্তত আছে। দ্যাখ, ক্লাবটার এদ্দিনে গতি হল। এবার উন্নত পরিকাঠামো, ঝাঁ চকচকে গ্যালারি, অফিস, আরো ক'টা জাপানি আর ব্রাজিলিয়ান প্লেয়ার… লোটনদের থোঁতা মুখ একদম ভোঁতা…"

অবাক হয়ে গেলাম। এ-টি-কের সঙ্গে গাঁটছড়ায় যে মোহনবাগান ক্লাবের ৮০ শতাংশ শেয়ার চলে গেল সঞ্জীব গোয়েঙ্কার হাতে। তাহলে এই নতুন ক্লাবের ভবিষ্যৎ কৃতিত্বের ভাগীদার কি আদৌ মোহনবাগানের? আশি শতাংশ শেয়ার মানে তো প্রায় পুরো ক্লাবটাই ফ্রাঞ্চাইজির হাতে তুলে দেওয়া! আরেকটু তলিয়ে ভেবে দেখুন না! মানে, এই নতুন দলটি যদি এ-এফ-সি কাপ চ্যাম্পিয়নও হয়, স্বতন্ত্র ক্লাব হিসেবে মোহনবাগান জিতবে কি? বরং এমন একটি দল ট্রফি তুলবে, যার সবুজ-মেরুন জার্সিতে হয়তো মোহনবাগানের পুরোনো লোগোটি রয়েছে মাত্র।

তাঁবুও হয়তো থাকবে। আরো ঝলমলে হয়ে উঠবে পুজো প্যান্ডেলের মত। দাপিয়ে বেড়াবেন টুটু বসুরা। থাকবে সমর্থকদের গ্যালারি। কিন্ত আসলে তা এত বছরের ঐতিহ্য বা আবেগকে একরকম শো-পিস হিসেবে সাজিয়ে রাখা।

দীর্ঘ ১৩০ বছরে ময়দানের ঘাস বদলেছে অনেকটাই। সমসাময়িক এরিয়ান্স ক্লাব আজ ইতিহাসের অন্তরালে। বহু তাঁবু ভাঙা-গড়ার সাক্ষী মোহনবাগান। এক-একটা ফুটবলের ক্লাব তো গড়ে ওঠে, আঞ্চলিক জাতিসত্তার প্রতিনিধি হিসেবে। ইস্ট ইয়র্কশায়ার ১৯১১-য় হেরেছিল বাংলার দামাল ছেলেদের কাছে। 'পালতোলা নৌকো' সেই থেকেই তো ব্রিটিশবিরোধী প্রতিস্পর্ধার পথিকৃৎ। ঔপনিবেশিক ভিনদেশিদের বিরুদ্ধে দেশের জবাব।

উল্টোদিকে ব্যাপক টাকার লগ্নিতে হঠাৎ গড়ে ওঠা ফ্র্যাঞ্চাইজি সিস্টেম তো উপর থেকেই চাপানো একটি নির্দিষ্ট কর্পোরেট মডেল। অনেকটা ক্রিকেটে, আইপিএলের মতো। যেখানে মুম্বইয়ের শাহরুখ হয়ে পড়েন বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। রাজ্যের খেলোয়াড়রাই বাদ পড়ে 'কলকাতা'-কেন্দ্রিক দল থেকে। হিন্দি-মিশ্রিত-বাংলায় স্লোগান ওঠে ‘কোরবো-লড়ব-জিতবো রে…’ সমর্থকদের হাতে গড়া ক্লাবকেন্দ্রিক আবেগকে সরিয়ে এক নতুন ধরনের সমর্থন পাচ্ছে আইএসএল।

ভারতীয় ফুটবলে মন্দা বহুদিনের। প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলও স্পনসর হারাচ্ছে। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, তারা নাকি ওড়িশার একটি 'দলে'র সঙ্গে চুক্তিতে যেতে চায়। ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবলের অদম্য গতির সঙ্গে কিছুতেই তাল মেলাতে পারছে না ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলো। তাই মুখ থুবড়ে পড়ে জমি হারাচ্ছে একে একে।

আবার মোহনবাগান গ্যালারি ভরে যাবে। সমর্থকরা গলা ফাটাবেন নতুন দলের হয়ে। তবে বাংলা ফুটবলের অবশিষ্ট ছিটেফোঁটাকে সমূলে উপড়ে ফেলার প্রক্রিয়ার হয়তো সূচনা হল এখন থেকেই।

আমার কথায় পক্ষপাত আছে নিঃসন্দেহে। সুতরাং, আসুন এই পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তগুলিকে প্রশ্নচিহ্নে বদলে দিই।

প্রশ্ন করছি শুধুই…

এ-টি-কে-মোহনবাগান, আদৌ মোহনবাগান তো? ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের শরিক, জাতীয় ক্লাবের গৌরব আর আইএসএল জয় কি এক ব্র্যাকেটে মানায়?

ভাবছি আমরা। ভাবুন আপনারাও!

তবে দয়া করে এখানে ইস্ট-মোহনের কাদা ছোড়াছুড়ি টেনে আনবেন না। কারণ মোহনবাগান শুধু সমর্থকদের সম্পত্তি নয়। তা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসের দলিল।