আলোচনার বালাই নেই, কেন্দ্রের একের পর এক ‘সংস্কার’ বিলে ধরাশায়ী কৃষক-শ্রমিকরা

প্রথমে কৃষি; তারপর শিল্প। কেন্দ্রের সংস্কারের ধাক্কায় বিতর্কের ঢেউ দেশ জুড়ে। সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হতেই কৃষি এবং শিল্পের সংস্কারের জন্য বেশ কিছু বিল লোকসভা ও বিধানসভায় নিয়ে এসেছে কেন্দ্র। সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিলগুলি পাশ হয়ে যাওয়াও সময়ের অপেক্ষাই। কিন্তু লক্ষ্য ‘সংস্কার’ হলেও কেন এত বিতর্ক বিলগুলিকে ঘিরে? একবার দেখা যাক কী আছে কেন্দ্রের আনা এই কৃষি এবং শিল্প বিলে।

কৃষিপণ্যের বাণিজ্যের উদারিকরণের লক্ষ্যেই মূলত তিনটি বিল নিয়ে আসার কথা জানিয়েছিল কেন্দ্র। এগুলি হল, অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন বিল, কৃষি পণ্যের লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন সংক্রান্ত বিল এবং কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত করতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি সংক্রান্ত বিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতাবলে এই বিল তিনটিকে ইতিমধ্যেই লোকসভায় পাশ করিয়ে নিতে কোনও সমস্যা হয়নি শাসক দলের। যদিও রাজ্যসভায় পেশ হয়েছে কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন এবং কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত করতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি সংক্রান্ত বিল দু’টি। বিরোধীদের তুমুল প্রতিবাদ উড়ে গেল ফুৎকারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধ্বনি ভোটের কাছে।

বিল পেশের পর কেন্দ্রীয় কৃষি উন্নয়ন মন্ত্রী বুক ফুলিয়ে জানিয়েছেন, এই বিলের ফলে আরও শক্তিশালী হবে দেশের কৃষকেরা। নিজের ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন তাঁরা। যদিও স্বাধীনতার এত বছর পরেও এখনও কৃষকদের উন্নয়নের জন্য নতুন বিল আনতে হয়, এর থেকে বেশি দুর্ভাগ্যের আর কীই বা হতে পারে!

যদিও, এই বিল পেশের পর থেকেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। কৃষকদের মৃত্যু পরোয়ানা এই বিল, এইভাবেই সরকারকে আক্রমণ করেছে বিরোধীরা। যুক্তিও আছে তার পিছনে। কেন্দ্র সরকারের মতে, এই বিলগুলির ফলে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করা হবে যেখানে কৃষক এবং কৃষি ব্যবসায়ীরা রাজ্যের কৃষি সংক্রান্ত বাজার কমিটির আওতায় না থেকেও বিক্রি করতে পারবেন তাঁদের উৎপাদিত ফসল। এক্ষেত্রে নিবন্ধিত কৃষি মান্ডির ক্ষমতা খর্ব করাই কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য। কেন্দ্রে যুক্তিতে, এর ফলে বিপণন ও পরিবহন ব্যয় কমবে এবং কৃষকদের ই-কমার্সের আওতায় আনাও সুবিধাজনক হবে। অর্থাৎ মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা কমানো কেন্দ্রের একটি মূল লক্ষ্য। সংসদে কেন্দ্র জানিয়েছে, এর ফলে পাঁচ হেক্টরের কম জমির মালিক এবং প্রান্তিক ক্ষুদ্র চাষিরা লাভবান হবেন। তাছাড়াও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে খাদ্যশস্য, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ এবং আলু জাতীয় ফসল। এর ফলে আগের মতো আর এই পণ্যগুলি মজুত করতে সীমা থাকছে না কোনও। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবে কৃষিক্ষেত্রে। কোল্ড স্টোরেজের মতো কৃষি পরিকাঠামো গড়ে উঠবে আরো বেশি। বাজারে প্রতিযোগিতা যেমন আসবে, তেমনই স্থিতিশীলতা আসবে দামেও। ফলে লাভবান হবেন কৃষক এবং গ্রাহক উভয়ই।

কিন্তু তাহলে বিরোধীদের আপত্তিটা কোথায়? এই বিলের মূল সমস্যাগুলি লুকিয়ে আছে মূলত লাইনের মাঝের ফাঁকগুলিতে। প্রায় সমস্ত বিরোধী দলগুলি জানিয়েছে, এই ব্যবস্থার ফলে বড়ো ক্ষতি হবে রাজ্যগুলির রাজস্ব সংগ্রহের। কৃষি মান্ডি যদি হিসেবের বাইরে চলে যায়, তাহলে রাজ্যগুলি তাদের জন্য নির্দিষ্ট ‘মান্ডি ফি’ আদায় করতে পারবে না আর। মূল বিতর্ক উঠে এসেছে যে, এই বিল শেষ পর্যন্ত সরকারের বেঁধে দেওয়া ন্যূনতম সমর্থিত মূল্য ব্যবস্থার অবসান ঘটাবে কিনা? তাছাড়াও কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলিও কৃষি মান্ডির পরিকাঠামোই ব্যবহার করে। তাই এক্ষেত্রে কৃষি মান্ডিগুলির অবলুপ্তি ঘটিয়ে কেন্দ্র এই ব্যবস্থাটিরও বেসরকারিকরণ করতে যাচ্ছে কিনা, সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়াও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে যেখানে সাক্ষরতার হার অত্যন্ত কম, সেখানে কীভাবে তাঁরা বহুজাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে দর কষাকষি করবেন, তা ভেবেও আশ্চর্য হয়েছেন অনেকেই। এক্ষেত্রেও ছোট কৃষকদের বদলে ধনী কৃষকেরাই লাভের গুড় খেয়ে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তবে শুধুমাত্র কৃষি ক্ষেত্রেই নয়, বিতর্কের রেশ টেনেই নতুন বিল লোকসভায় পেশ করে ফেলল কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক। এই বিল পেশ হওয়ার পরেই দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাওয়া আশ্চর্যজনক নয়। এই বিলে দাবি করা হয়েছে, যে সকল সংস্থায় কর্মচারীর সংখ্যা ৩০০ জনের কম, সেখানে কর্মীদের ছাঁটাই করতে অথবা সংস্থা বন্ধ করে দিতে আর সরকারি অনুমতি লাগবে না। এই বিলের বক্তব্য অনুযায়ী কর্মী ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে আর প্রতিবাদ, আন্দোলন অথবা ধর্মঘটে সামিল হতে পারবেন না শ্রমিকেরা। এতদিন ধরে ১০০ জনের কম কর্মী রয়েছে এমন সংস্থাতেই প্রচলিত ছিল এই নিয়ম। কিন্তু সেই নিয়মের পরিবর্তনের ফলে অশনিসংকেত দেখছেন দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক।

আরও পড়ুন
ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের আর্জি কেন্দ্রের, অপপ্রচার আটকানোর আড়ালে কি বিরোধীদের কণ্ঠরোধ?

এমনিতেই বর্তমানে কোভিড পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন সংস্থায়। লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে বেকারত্বের হার। তার মধ্যেই কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্তে যে আরও খারাপ হবে পরিস্থিতি, তা বলাই বাহুল্য। একদম খাদের কিনারায় গিয়ে ঠেকেছে শ্রমিকদের নিরাপত্তা। নতুন শ্রমিক বিলের বিরোধিতায় সরব হয়েছেন বিভিন্ন সংগঠন। অভিযোগ উঠেছে, এই বিলের ফলে স্বার্থ বিঘ্নিত হবে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মীদের। তাছাড়াও রাজ্যের অভ্যন্তরীণ পরিযায়ী শ্রমিক এবং মহিলাদের জন্যেও আলাদা করে নির্দিষ্ট কোনও সুবিধার কথাও উল্লেখ করা হয়নি এই বিলে। ফলে আশঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই নতুন শ্রম বিল লাগু হয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে দেশজুড়ে ইতিমধ্যেই ধুঁকতে থাকা শ্রমিক সমাজের।

স্বাভাবিকভাবেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, এই কৃষি বিলের ফলে সরকার কৃষক উন্নয়নের দায় ঝেড়ে ফেলছে কিনা? যদিও প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন যে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বিলুপ্ত হবে না। কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখার নজির কোথায়ই বা আছে এই সরকারের! সুতরাং দেশের অন্যান্য রাষ্ট্রয়ত্ত সংস্থার মতো দেশের মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি কৃষিকাজও না এবার বেসরকারি হাতেই চলে যায়, সেই আশঙ্কাতেই দিন গুনছেন কৃষক সম্প্রদায়।

তার থেকেও বড় আশঙ্কার কথা, কোনোরকম আলোচনা বা প্রশ্ন ছাড়াই এই বিলগুলি পাস হয়ে যাচ্ছে সংসদে। দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে এটা অত্যন্ত ক্ষতিকারক একটি ইঙ্গিত। যদি ন্যুনতম কোনও সুরক্ষা না থাকে দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের, তাহলে কিসের ভিত্তিতে এই সরকারকে জনগণের সরকার বলা হবে? প্রশ্নগুলো কিন্তু থাকছেই। তার সঙ্গেই থাকছে সরকারের যাবতীয় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ। সংস্কারের বদলে যাকে ‘হস্তান্তর’ বললেও অত্যুক্তি হয় না। এইভাবে দেশ আসলেই ঠিক কতটা স্বাবলম্বিতার দিকে এগিয়ে যাবে, তা নিয়ে সন্দেহের মেঘ কিন্তু একটা থেকেই যায়। দুর্ভাগ্যের কথা হল, এই সন্দেহের মেঘ কাটানোর মতো কোনও উপায় আপাতত কেউই দেখাতে পারছেন না।

আরও পড়ুন
১৪ মাসে আত্মহত্যা ১৩ কর্মীর, ছাঁটাইয়ের পথে আরও ২০ হাজার; খাদের কিনারায় বিএসএনএল?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More