শতাধিক বরেণ্য বাঙালির রেখাচিত্র, নববর্ষের প্রাক্কালে ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী কলকাতায়

“আমরা এমন একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, প্রতিনিয়তই আমাদের উপর আগ্রাসন চলছে নানাভাবে। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি— বাঙালির যে উত্তরাধিকার, সেগুলোকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে ক্রমশ। সেইসঙ্গে ছাতার মতো মানুষরাও চলে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে। অভিভাবকহীন হয়ে উঠছি আমরা…”

বলছিলেন চিত্রকর শুভেন্দু সরকার (Subhendu Sarkar)। ভাষা আগ্রাসনের যুগে দাঁড়িয়ে, বাঙালিয়ানাকেই নতুন করে হাতিয়ার করে নিয়েছেন তিনি। তরুণ প্রজন্মকে বাংলার ঐতিহ্য, ইতিহাসের পাঠ দিতে তুলে নিয়েছেন রং-তুলি। ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন স্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্বদের রেখাচিত্র এবং তাঁদের কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এভাবেই যেন বাঙালিকে তার শিকড়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন শিল্পী। বিশ্বাস, প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বদের স্মরণ না করলে একটা সময় গতিরুদ্ধ হয়ে পড়বে বাঙালি জাতি। তাঁর কথায়, “আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে উত্তরাধিকারের চর্চাটা অত্যন্ত জরুরি একটা বিষয়। একজন বাঙালি হয়ে সেটা দায়িত্বও বটে।”

এবার নববর্ষের প্রাক্কালে শিল্পী শুভেন্দু সরকারের আঁকা এমনই একশো আটজন স্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্বের (Historic Bengali Personalities) রেখাচিত্র নিয়েই আয়োজিত হতে চলেছে বিশেষ চিত্র প্রদর্শনী ‘বাঙালি অষ্টোত্তর শতনাম’। উপস্থাপক জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের উদ্যোগে বিড়লা অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে আগামীকাল অর্থাৎ ১২ এপ্রিল থেকেই শুরু করে এই প্রদর্শনী। 

আরও পড়ুন
স্কুলবেলা থেকেই সিনেমার জন্য লড়াই, ‘এশিয়ান’-এ স্থান পেলেন বাঙালি পরিচালক

শিল্পী শুভেন্দু সরকার

 

আরও পড়ুন
বাঙালির সুভাষ পালক, নেতাজি উড়ান

সুকুমার থেকে প্রফুল্লচন্দ্র, বেগম রোকেয়া থেকে বঙ্গবন্ধু— দুই বাংলার প্রণম্য ব্যক্তিত্বরাই জায়গা পেয়েছেন শুভেন্দুবাবুর ক্যানভাসে। আসলে কাঁটাতার, বিভাজন ছাড়িয়ে বাঙালিয়ানার ইতিহাস, সংস্কৃতি যে বিস্তৃত বহুদূর পর্যন্ত। সেই ইতিহাসের অনুসন্ধান করতে করতেই ষোড়শ শতকেও কখনও ফিরে গেছেন কলকাতার শিল্পী। তবে কেবলমাত্র ১০৮ জন ব্যক্তিত্বকে বেছে নেওয়ার কাজ খুব একটা সহজ ছিল না তাঁর কাছেও। “প্রণম্য বাঙালি ব্যক্তিত্বদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু প্রদর্শনীর ফর্ম্যাটে সবসময়ই কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকে। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের বেছে নিতে হয়েছে ১০৮ জনকে। এই ১০৮ জনের স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়েই বাঙালিয়ানার চর্চার বার্তাটা পৌঁছে দেওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য”, জানালেন শুভেন্দুবাবু। 

আরও পড়ুন
হুগলি নদী ও পৃথিবীর ‘বন্ধুত্বের’ প্রদর্শনী

এই উদ্যোগ অভিনব তো বটেই, তবে অভিনবত্ব লুকিয়ে রয়েছে প্রতিটি ছবির মধ্যেও। বাঙালি ব্যক্তিত্বদের ইতিহাস ফুটিয়ে তুলতে ছকভাঙা এক আর্ট ফর্মের সন্ধান করেছেন শিল্পী। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, প্রতিটি ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতিতেই বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে মুখমণ্ডলে। শরীরের তুলনায় খানিকটা বড়ো করেই যেন আঁকা হয়েছে তাঁদের মুখাবয়বের ছবি। অনেকটা ক্যারিকেচারের মতোই। তবে শিল্পীর কথায়, “ক্যারিকেচার শব্দটা এখানে প্রযোজ্য নয়। ক্যারিকেচারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবেই জুড়ে থাকে ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি। এক্ষেত্রে বাংলার অগ্রগতিতে তাঁদের অবদান এবং পরিসরকে ফুটিয়ে তুলতেই এভাবে আঁকা হয়েছে ছবিগুলি।” মুখমণ্ডলের স্বল্প-বিস্তর বিকৃতিও ক্যারিকেচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেটিকেও সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন শিল্পী। আসলে আজকের প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের কাছে অবিকৃত ইতিহাস তুলে ধরাই লক্ষ্য শুভেন্দুবাবুর। “কালীপ্রসন্ন সিংহ বা কেশববাবুর মতো বাঙালি ব্যক্তিত্বদের মুখের সঙ্গে ততটাও পরিচিত নয় আজকের প্রজন্ম। কাজেই অবিকৃতভাবে তাঁদের পরিচয় তুলে ধরাও একটা দায় শিল্পীর”, যোগ করলেন শুভেন্দুবাবু। 

চলতি মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত চলবে এই চিত্রপ্রদর্শনী। প্রদর্শনীর শেষ লগ্নে থাকবে আরও একটি বড়ো চমক। এই বিশিষ্ট একশো আটজন ব্যক্তিত্বের গল্প শোনাবেন খ্যাতনামা সাংবাদিক ও কথাশিল্পী শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। তুলে আনবেন বাঙালি নক্ষত্রদের জীবন দর্শন, সংগ্রামের কথা। এভাবেই যেন সেতুবন্ধন হতে চলেছে পূর্ববর্তী প্রজন্মের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীর…

Powered by Froala Editor