গ্রন্থপ্রকাশে মণিপুর সরকারের নজরদারি, ইতিহাস-রক্ষার নামে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ?

মণিপুরের ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে বিভিন্ন গ্রন্থে। মাস খানেক আগের কথা। ২০ আগস্ট ৩১তম ‘মণিপুর ভাষা দিবস’ উদযাপনের সময় সাংবাদিক সম্মেলনে এমনটাই অভিযোগ জানান মণিপুরের (Manipur) মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহ (Biren Singha)। এবার মাস ঘুরতেই নতুন আইন জারি করলেন তিনি। সরকারের আদেশে গঠিত হল একটি বিশেষ প্রাক-অনুমোদন কমিটি। মণিপুরের ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সংক্রান্ত যে-কোনো গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রকাশের আগে জমা দিতে হবে এই কমিটির কাছে। অর্থাৎ, বর্তমানে গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে এই কমিটির অনুমতি নেওয়া একরকম বাধ্যতামূলক আইনে পরিণত হল মণিপুরে।

প্রশ্ন থেকে যায় হঠাৎ কেন এ-ধরনের আইন? গত আগস্টে কেনই বা ইতিহাস-বিকৃতির অভিযোগ তুলেছিলেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী? 

‘কমপ্লেক্সিটি কলড মণিপুর : রুটস, পারসেপশন অ্যান্ড রিয়্যালিটি’। গত মে মাসে প্রকাশিত হয়েছিল সিআরপিএফ-এর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সুশীল কুমার শর্মার লেখা এই থিসিস। আর তার পরেই সূত্রপাত এই বিতর্কের। এই গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, ১৯৪৯ সালে ভারতের অন্তর্ভুক্তির সময় মণিপুর প্রিন্সলি স্টেটের আয়তন ছিল ৭০০ বর্গমাইল অর্থাৎ ১৮১২ বর্গকিমি। স্বাভাবিকভাবেই সুশীল কুমারের প্রকাশিত এই নকশায় বাদ পড়েছিল মণিপুরের নাগা, কুকি এবং অন্যান্য উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চল। 

সে-সময়ই এই গ্রন্থের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ‘ইনডিজিনাস পিপলস অ্যালায়েন্স’, ‘ইয়ুথ ফর পিস অ্যান্ড প্রগ্রেস’, ‘ফেডারেশন অফ হাওমি’-সহ একাধিক সংস্থা। এমনকি খোদ লেখক এবং তাঁর গাইডদের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল। বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি ওঠে রাজ্যজুড়ে। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীও। আগামী প্রজন্মের কাছে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে যাতে ভুল তথ্য না যায়, তার জন্যই এবার নতুন আইন প্রণয়ন করলেন তিনি। 

অবশ্য সুশীল শর্মার গ্রন্থটির বিরোধিতা করলেও, রাজ্যের এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন না অনেকেই। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ ও ইতিহাস রক্ষার কর্মসূচি সামনে রেখে মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে রাজ্য সরকার। এমনটাই দাবি অনেকের। সরকারের এই সিদ্ধান্ত এককথায় অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে বলেই অভিযোগ মানবাধিকার কর্মীদের। এই নজরদারি একপ্রকার ওপেন সেনসরশিপই বটে। আগামীদিনে এই নজরদারি চললে কোনো বিষয়েই বিতর্কের অবসর থাকবে না কোনো। সুযোগ থাকবে না গবেষণার। বরং, সরকার-নির্ধারিত ইতিহাসকেই চাপিয়ে দেওয়া হবে মানুষের ওপর। 

সরকারের এই সিদ্ধান্ত ঘিরে রীতিমতো সাড়া পড়ে গেছে প্রকাশনা জগতেও। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জোট বাঁধছে একাধিক প্রকাশনা। এখনও পর্যন্ত নিজেদের নাম প্রকাশ না করলেও, আদালতের কাছে দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। এখন দেখার এই বিতর্কের জল কতদূর গড়ায় মণিপুরে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More