সাইকেলে চেপে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিচ্ছেন ‘গুরুজি’

প্রখর গ্রীষ্মের দুপুর। কিংবা ভরা বর্ষা। তার মধ্যেও সাইকেল নিয়ে চলেছেন এক ব্যক্তি। ঝোলানো একটা বড়ো ব্যাগ। সাইকেলের সামনে-পিছনে, এমনকি রড দিয়ে মাথার পিছনে দু-তিনটি পোস্টার। ফোন নম্বর দেওয়া। হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে লেখা তাঁর নাম, কয়েকটি ছবি আর কিছু বক্তব্য। কোথায় চলেছেন তিনি? কেউ জানে না, তিনি নিজেও জানেন না। ‘ভোজন যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে’। কিন্তু কিছু তো উদ্দেশ্য একটা। নাহলে এরকম গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতে একজন সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কেন? তাঁর লক্ষ্য একটাই। সাইকেলে নিয়ে ঘুরবেন সারা দেশ আর পড়াশোনা শেখাবেন দুঃস্থ-বঞ্চিত শিশুদের। কম করে এক কোটি শিশুকে সাক্ষর করে তবে তিনি বিশ্রাম নেবেন। সাময়িক বিশ্রাম...

পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক আদিত্য কুমারের (Aditya Kumar) সঙ্গে। ‘সাইকেল গুরুজি’ (Cycle Guruji) নামেই এখন যিনি অধিক জনপ্রিয়। জন্ম উত্তরপ্রদেশের ফারুক্কাবাদে। যদিও এখন কোনো ঠিকানা নেই। উত্তরপ্রদেশ-সহ দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়ান। যেখানে পৌঁছোয়নি শিক্ষার আলো। নেই স্কুল, নেই পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা। সেখানেই তাঁর কাজ। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও এদেশের বহু গ্রামে মানুষের কাছে শিক্ষার সুযোগ পায় না কেন? এই প্রশ্নটাই ভাবিয়েছিল আদিত্যকে। কাউকে দোষারোপ করেননি, কোনো অভিযোগ আনেননি। শুধু একদিন বেরিয়ে পড়েছিলেন তাঁর সাইকেলটি নিয়ে।

পরিবারের অবশ্য আপত্তি ছিল। ১৯৯৫ সালে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করার পর পরিবার চেয়েছিল এবার ছেলে চাকরি করুক। সংসারী হোক। কিন্তু তাঁকে তাড়িয়ে বেরিয়েছিল শৈশবের দারিদ্র্য। নিজের জীবনেও তো একই অন্ধকার দেখেছেন তিনি। থাকতে হয়েছে অভুক্ত। ক্রমে মনে হয়েছিল শিক্ষাও হয়তো বিক্রয়যোগ্য। আর্থিক সামর্থ্য থাকলেই পাওয়া যায় শিক্ষার সুবিধা। কলেজে পড়াকালীনই নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছিলেন। গৃহশিক্ষকতা করতেন। বিনামূল্যে শিক্ষাদান করেছেন বহু ছাত্রছাত্রীকে। তখন থেকেই চোখের সামনে উঠে আসতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পুরো ছবিটা।

ঘর ছাড়লেন আদিত্য। কিছুটা বাধ্য হয়েই। বাড়ির লোকের বোঝা পক্ষে অসাধ্য ছিল তাঁর কাজকর্ম। থাকতে শুরু করেন লক্ষ্মৌ স্টেশনে। আর আশেপাশের বাচ্চাদের পড়াশোনা করাতে লাগলেন। পরিচিতিও বাড়ে। সাধারণ মানুষই কিনে দেয় একটি সাইকেল। শুরু হল দেশ পরিক্রমা। উত্তরপ্রদেশ দিয়ে শুরু হলেও এখন পৌঁছে গেছেন অন্যান্য রাজ্যেও। কোনো বিশেষ জায়গা বেছে নিয়ে সেখানেই থাকেন কয়েকদিন। গ্রামের শিশুদের সাক্ষর করে পাড়ি দেন অন্য কোনো স্থানে।

আরও পড়ুন
বস্তিবাসী শিশুদের শিক্ষকের ভূমিকায় পুলিশ অফিসার

সম্মান পেয়েছেন বহু প্রতিষ্ঠান থেকে। ২০১৮-তে গুগল তাঁকে সম্বর্ধিত করেন ‘ভারতের এক নম্বর শিক্ষক’ শিরোনামে। পেয়েছেন ‘জাতীয় নায়ক’-এর শিরোপা। গিনেস বুক অফ রেকর্ডসের তালিকাতেও আছে তাঁর নাম। তবে এগুলোর থেকে অনেক বেশি আদরের বহু মানুষের সান্নিধ্য, তাঁদের ভালোবাসা। দেখেছেন বহু শিশুর মুখে হাসি। সম্বল বলতে তো এটুকুই। আর আশা, ‘ভারতযাত্রা’-য় দেশের এক কোটি শিশুর কাছে পৌঁছে দেবেন শিক্ষার আলো। ইতিমধ্যে নিয়েছেন চার লক্ষ ক্লাস। শুধু সাক্ষরতা অভিযান নয়, শিক্ষানুরাগী মানুষদের দেখান সঠিক পথের নিশানা। 

আরও পড়ুন
মাটির দেওয়ালই ব্ল্যাকবোর্ড, প্রান্তিক ঝাড়খণ্ডকে দিশা দেখাছেন স্কুল শিক্ষক

পথই খুঁজে নিয়েছেন আদিত্য। সাইকেলে ঘুরে পৌঁছে যাচ্ছেন অজানা জায়গায়। কোনো ঠিকানা নেই তাঁর। ভারতের পথই ঘরবসতি। লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন ঠিক। এক কোটি? সে তো একটা সংখ্যামাত্র...

Powered by Froala Editor