৪০টিরও বেশি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে তাঁর নাম, মুক্তি পেলেন ‘বিকিনি কিলার’

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়। অকুস্থল থাইল্যান্ড। পশ্চিমি দেশ থেকে বেড়াতে এসে বেপাত্তা হয়ে যাচ্ছিলেন একের পর এক শ্বেতাঙ্গ পর্যটক। বিশেষ করে মহিলারা। কিছুদিন পর সমুদ্রের ধার থেকে উদ্ধার হত তাঁদের দেহ। পরনে বিকিনি। ফরেন্সিক রিপোর্টে উঠে আসে, প্রথমে মাদক প্রয়োগ করে অজ্ঞান করা হয় তাঁদের। তারপর আগুনে ঝলসে নৃশংসভাবে খুন। প্রতিক্ষেত্রেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। 

এই ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের পিছনে যে কোনো সিরিয়াল কিলার লুকিয়ে রয়েছেন তা অনুমান করা যায় সহজেই। কিন্তু কে এই হত্যাকারী? ঘাতকের পরিচয় নাগালে পেতেই থাই পুলিশের লেগে গিয়েছিল প্রায় দু-বছর। তবে পরিচয় প্রকাশ্যে আসার পরও কোনোদিন তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ক্ষুরধার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বার বার সরীসৃপের মতো পালিয়ে গেছেন পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে।

চার্লস শোভরাজ (Charles Sobhraj)। দীর্ঘ ১৯ বছর নেপালে জেলবাসের পর এবার ছাড়া পেলেন ‘বিকিনি কিলার’ (Bikini Killer) বা ‘দ্য সারপেন্ট’-খ্যাত ফরাসি সিরিয়াল কিলার। বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই হৃদযন্ত্রের রোগে ভুগছিলেন শোভরাজ। শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে কারামুক্তির আবেদনও করেছিলেন নেপালের সুপ্রিম কোর্টে। গত বুধবার তাঁর সেই আবেদন মঞ্জুর করে সে-দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর পরই স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ্যে আসে তাঁর জেলমুক্তির ছবি। পুলিশের গাড়ি চেপেই হাসপাতালে যান চার্লস শোভরাজ। অবশ্য সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে আসেনি তাঁর গন্তব্য বা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের নাম। 

পুলিশের খাতায় চার্লস শোভরাজ নামে পরিচিত হলেও, এই নাম তাঁর বাবা-মায়ের দেওয়া নয়। বরং, তিনি ‘চার্লস’ ডাকনাম পেয়েছিলেন বান্ধবীদের থেকে। স্কুলজীবন থেকেই মহিলামহলে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ছিল তাঁর। চার্লি চ্যাপলিনের অভিনয় করেই মন কাড়তেন বান্ধবীদের। সেখান থেকেই ‘চার্লস’ উপাধি। ক্ষুরধার বুদ্ধির পাশাপাশি, চার্লস শোভরাজের এই ‘চার্ম’-ই ছিল তাঁর অন্যতম হাতিয়ার। 

হ্যাঁ, গোটা অপরাধজীবনে একজনকেও অপহরণ করেননি ‘বিকিনি কিলার’। বরং, নিজের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ করে নিজের কাছে নিয়ে আসতেন বিদেশি মহিলাদের। তারপর মাদকের সঙ্গে তাঁদের খাওয়াতেন চেতনানাশক ড্রাগ। জ্ঞান ফেরার পর শুরু হত খুনের নৃশংস প্রক্রিয়া। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সিরিয়াল কিলারের থেকেও ‘ম্যানিপুলেটার’ শব্দটিই বরং যথাযথভাবে বর্ণনা দিতে পারে অপরাধজগতের এই আশ্চর্য চরিত্রটির।

১৯৭৫ সালে শোভরাজের শিকার হন থাইল্যান্ডে ঘুরতে আসে এক ডাচ দম্পতি। উঠেছিলেন থাইল্যান্ডের ওলন্দাজ দূতাবাসে। ফলে, এহেন খুনেই আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে শোভরাজের কার্যকলাপ। নড়ে চড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। প্রকাশ্যে আসে, শুধু থাইল্যান্ডই নয়, তাঁর খুনের প্রেক্ষাপট ছড়িয়ে রয়েছে ভারত, নেপাল, ফ্রান্স, গ্রিস, আফগানিস্তান-সহ একাধিক দেশে। এবং আশ্চর্যের বিষয় হল, কেবলমাত্র মূল্যবান রত্ন এবং অর্থ হাতানোর জন্যই বারংবার রক্তে হাত ধুয়েছেন তিনি। সেইসঙ্গে শিকারদের থেকে চুরি করা পাসপোর্টই ছিল তাঁর এক দেশ থেকে অন্যদেশে পালানোর ট্রাম্পকার্ড। 

তবে শুধু খুনই নয়, নিগড় ভাঙাতেও যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন শোভরাজ। ভারতে ধরা পড়লেও, তিহার জেলের গারদ ভেঙে পলাতক হয়েছিলেন তিনি। তার বছর তিনেক পর ফের তিনি ধরা পড়েন নেপালে। বা বলা ভালো, নেপালের পুলিশের কাছে স্বয়ং ধরা দেন তিনি। সবটাই ছিল তাঁর ছক করা হিসেব। কেন-না, থাইল্যান্ড ও ফ্রান্সে তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত করা হয়েছে ততদিনে। অন্যদিকে ভারতে ধরা পড়লেও একই পরিণতি হতে পারে। তাই গারদবাসকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নেন শোভরাজ। 

তবে মহিলামহলে তাঁর খ্যাতি কমেনি এতটুকু। কারাগারে যাওয়ার আগে থেকেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন এক বাঙালি বংশোদ্ভূত নেপালি মহিলার সঙ্গে। সেটা ২০০৮ সাল। কাঠমাণ্ডুর জেলে থাকাকালীনই তাঁকে বিবাহ করেন শোভরাজ। তা নিয়েও চর্চা চলেছিল গোটা বিশ্বে। বলতে গেলে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে চিরকালই জায়গা পেয়ে এসেছেন কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার। এমনকি গতবছর তাঁকে নিয়ে ‘দ্য সারপেন্ট’-খ্যাত একটি ওয়েব সিরিজও মুক্তি পায় একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। এবার একযুগ পর তাঁর জেলমুক্তি নিয়েও ফের নতুন করে শুরু হয়েছে চর্চা…

Powered by Froala Editor