ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে হিন্দুত্ববাদের প্রতিফলন? ইউজিসির বিজ্ঞপ্তি ঘিরে বিতর্ক

পাঠক্রম বদলে ফেলার কাজটা যেন বারবার ইতিহাস বিষয়টিকে ঘিরেই শুরু হয়। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশ কোনো না কোনো সময় এমন পরিস্থিতির সামনে থেকেছে। আর এবার স্বাধীন ভারতেই প্রকৃত ইতিহাস মুছে ফেলার অভিযোগ উঠল কেন্দ্রীয় সংস্থার বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাম্প্রতিক নির্দেশিকাকে ঘিরে এমনই অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ। এই প্রথম সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের জন্য একটি সাধারণ ইতিহাস সিলেবাস তৈরি করেছে ইউজিসি। আর সেই সিলেবাসে প্রকৃত ইতিহাসের বদলে পুরাণ আর কাল্পনিক কাহিনির মিশেলে এক ধরণের হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ তৈরি করা হচ্ছে বলেই মনে করছেন অনেকে।

এতদিন ইউজিসি কোনো বিষয়ের জন্যই কোনো নির্দিষ্ট সিলেবাস দেয়নি। এই প্রথম সারা দেশের জন্য একই ইতিহাস সিলেবাস তৈরি হল। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকেই মনে করছেন, প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কিছু পঠপাঠনের ধারা তৈরি হয়ে যায়। সেটাকে এভাবে বন্ধ করে দিতে চাওয়া আসলে শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধীন স্বরকে দমন করারই নামান্তর। তবে তার থেকেও বড়ো অভিযোগ সিলেবাস নিয়েই। রামায়ণ, মহাভারতের মতো মহাকাব্যকে সাহিত্যের আঙ্গিকে না দেখে ইতিহাসের নথি হিসাবে দেখতে রাজি নন কেউই। তাছাড়া এদেশে মুসলমান শাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে এক কথায় এড়িয়েই যাওয়া হয়েছে সমগ্র পাঠক্রমে।

স্নাতক স্তরের প্রথম অধ্যায়েই ভারতের ধারণা গড়ে তুলতে গিয়ে শুধুই বেদ ও বেদান্তের উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যই ভারতের ঐতিহ্য, মনে করছেন ইতিহাসের গবেষকরা। সেখানে কোনো এক ধারার চিন্তাকে মূল অক্ষ ধরে নেওয়া যায় না। পাশাপাশি যে সভ্যতা আমাদের কাছে সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত, নতুন সিলেবাসে তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা’। ঐতিহাসিকরা যদিও সরস্বতী সভ্যতার কোনো অস্তিত্বের কথা জানেন না। তার উল্লেখ পাওয়া যায় পৌরাণিক সাহিত্যে। আর সেই সূত্র ধরেই সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে আর্য সভ্যতার যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টাও করা হয়েছে। আর কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বা মনুসংহিতার মতো বইকেও বিতর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অবকাশ নেই বলে মনে করছেন অনেকেই।

প্রশ্ন উঠছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দদোলনের ইতিহাস নিয়েও। সেখানে মহাবিদ্রোহের উল্লেখ আছে দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসাবে। এই তকমা দিয়েছিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার। কিন্তু তার আগেও যে অসংখ্য উপজাতি এবং সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ঘটেছিল, সেই ইতিহাস যেন বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছে সিলেবাসে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত পরিবর্তনের অধিকার দেওয়া হলেও তার মধ্যে পড়ুয়াদের কাছে সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন
পড়ুয়াদের ‘গো-বিজ্ঞান’ বিষয়ক পরীক্ষায় উৎসাহ দিতে উপাচার্যদের নির্দেশ ইউজিসি-র!

শিক্ষাক্ষেত্রে গৈরিকীকরণের অভিযোগ নতুন নয়। কিছুদিন আগেই গো-বিজ্ঞান পরীক্ষা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছিল ইউজিসি। আর এবারে বিতর্কের বিষয় ইতিহাস সিলেবাস। সঠিক ইতিহাস না জানলে যে দেশকে আসলে চেনা সম্ভব নয়, সেকথা বলাই বাহুল্য।

তথ্যসূত্র - UGC drafts undergraduate history syllabus: mythology drives ‘Idea of Bharat’, Basant Kumar Mohanty , The Telegraph 

আরও পড়ুন
দুর্গাপুজোর দিনেই ইউজিসির প্রবেশিকা পরীক্ষা, বাংলার পড়ুয়া ও সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা কেন্দ্রের?

Powered by Froala Editor

More From Author See More