কলকাতায় পশু নির্যাতন রুখতে উদ্যোগী সাহেব, ১৬০ বছর আগেই তৈরি করেছিলেন সংগঠন

কলকাতার বিখ্যাত লাল বাড়িগুলোর মধ্যে একটি মহাকরণ। ওই অঞ্চলটায় এলেই যেন ব্যস্ততার ছোঁয়া লাগে আমাদের গায়ে। যাই হোক, পুরনো সাহেবি কলকাতার একটা আঁচও পাওয়া যায়। তাই অনেকের মতো ইতিউতি ঘুরঘুর করা যেতেই পারে। এইসময় যদি একটু চোখ কান খোলা রেখে চলেন, তাহলে চোখে পড়বে অনেক বিচিত্র ও ঐতিহাসিক জিনিস। যেমন একটি লম্বা সাদা স্তম্ভ। রাইটার্স বিল্ডিং বা মহাকরণের উল্টোদিকের ফুটপাতেই রয়েছে এটি। চকচকে, সাদা মার্বেলের একটি স্তম্ভ। এর দুপাশে সিংহের মুখ প্রমাণ জানায় ব্রিটিশ রাজশক্তির। 

সেসব দেখে স্তম্ভের নিচের ফলকটির দিকেও একটু নজর দেওয়া যাক। ১৮৮১ সালে তৈরি এই স্তম্ভটি আসলে একটি স্মৃতিসৌধ। যার জন্য তৈরি, তাঁর নামটি রয়েছে গোটা গোটা অক্ষরে— কোলেসওয়ার্দি গ্রান্ট। পরিচয় হিসেবে লেখা ‘ফাউন্ডার অফ ক্যালকাটা সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস’। সেটা কী? আর কোলেসওয়ার্দিও কে ছিলেন? 

বর্তমান কলকাতা থেকে একটু ইতিহাসের দিকে ফেরা যাক। লন্ডনের এক স্কটিশ পরিবারে জন্মেছিলেন কোলেসওয়ার্দি গ্রান্ট। বাবা গাণিতিক যন্ত্র তৈরি করতেন। ছোটো থেকে সেসবই দেশে বড়ো হয়েছিলেন। তারপর ১৯ বছর বয়সে চলে এলেন কলকাতায়, ১৮৩২ সালে। দাদার সঙ্গে ঘড়ি তৈরি করতে লাগলেন কোলেসওয়ার্দি। এমন সময় ঘটল দুর্ঘটনা। পড়ে গিয়ে শিরদাঁড়ায় মারাত্মক চোট পেলেন। আর এটাই তাঁকে সারাজীবনের মতো অকেজো করে রাখল। সোজা হয়ে হাঁটার শক্তিই হারিয়ে ফেললেন কোলেসওয়ার্দি। 

কথায় বলে, যখন একটা কিছু চলে যায় তখন এমন কিছুর দরজা খুলে যায় যা আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ঠিক সেটাই হয় এই ক্ষেত্রে। কলকাতা শহর তখন ব্রিটিশদের প্রাণভোমরা। কত মানুষ, রাজা-রাজড়া; বিচিত্র তাঁদের জীবন। কোলেসওয়ার্দি নজর রাখলেন এখানে। হাতে উঠে এল পেনসিল আর পেন; শুরু হল তাঁর স্কেচিং জীবন। আজকের ক্রিক রো-এর কাছেই থাকতেন তিনি। ইন্ডিয়ান রিভিউ আর ক্যালকাটা মান্থলি— এই দুটো পত্রিকায় চিত্রশিল্পী ও লেখক হিসেবে যুক্ত হন তিনি। আস্তে আস্তে নামও ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। সুখ্যাতি পৌঁছে যায় বড়লাট লর্ড ডালহৌসির কাছেও। 

সেই সময় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরই ছবি এঁকেছিলেন কোলেসওয়ার্দি। আজও সেইসব আর্কাইভাল হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সি কলেজে (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) আঁকার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। ডঃ ফ্রেডেরিক মোয়াটের ‘অ্যাটলাস অফ অ্যানাটমি’র ইলাস্ট্রেশনও করেছিলেন তিনি। 

এ তো গেল তাঁর আঁকার কথা। কোলেসওয়ার্দি গ্রান্টের জীবনের গল্প এতেই থেমে থাকে না। এত কিছু হওয়ার পরও তাঁর অন্যতম বড়ো পরিচয় একজন পশুপ্রেমী হিসেবে। পশুপাখিকে ভালোবাসতে গেলে মাংস খাওয়া যাবে না, এমন একটি কথা সবসময় প্রচলিত। অনেকে স্বপক্ষে কথা বলেছেন, অনেকে বিপক্ষে। কোলেসওয়ার্দি এই দ্বিতীয় দলে ছিলেন। প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন এদের। লালদিঘির উল্টোদিকে ঘোড়াদের জল খাওয়ার জন্য তৈরি করেছিলেন চৌবাচ্চা; যা এখনও আছে। সেই সঙ্গে আছে ‘ক্যালকাটা সোসাইটি ফর প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস’। 

আরও পড়ুন
কলকাতার প্রথম চাইনিজ রেস্তোরাঁ নানকিং; এসেছেন রবীন্দ্রনাথ, এমনকি রাজ কাপুর-নার্গিসও

১৮৬১ সালে তৈরি হয় সংস্থাটি। ১৮২৪ সালে ইংল্যান্ডের সোসাইটি ফর প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস প্রতিষ্ঠানটির অনুকরণেই তৈরি হয়েছিল এটি। গোটা এশিয়ায় এরকম সংগঠন তার আগে ছিল না। ঠিক এর আট বছর পর ১৮৬৯ সালে কোলেসওয়ার্দি গ্রান্ট ও প্যারীচরণ মিত্রের চেষ্টায় জীবজন্তুদের ওপর অত্যাচার রুখতে একটি আইন পাশ হয়। ভারতে প্রথম এমন কোনো উদ্যোগ তৈরি হয়েছিল। আজও একইভাবে কাজ করে যাচ্ছে গ্রান্টের প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি। জীবনের শেষের দিকে এসে ইংল্যান্ডের মূল সংস্থাটি থেকে সাম্মানিক ডিপ্লোমাও পান তিনি। 

১৮৮০ সালের ৩০ মে থেকে কোলেসওয়ার্দি গ্রান্টের ঠিকানা বদলে যায়। তাঁর জায়গা হয় সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে। আর তার পরের বছর রাইটার্সের উল্টোদিকে তৈরি হয় এই মার্বেলের স্মৃতিফলক। এভাবেই কলকাতার এক বিদেশি পশুপ্রেমী বেঁচে আছেন। কাজের মহ্যে দিয়ে, স্মৃতিফলকের মধ্যে দিয়ে, এবং অবশ্যই ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
এক বাসে সরাসরি কলকাতা থেকে লন্ডন, ৫০ বছর আগে পৃথিবীর দীর্ঘতম বাস রুট ছিল এটিই

More From Author See More