হাজার হাজার বছর আগের কথা। চিনের ইয়াংসি কিয়াং নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল প্রাচীন এক সভ্যতা। যত সময় গড়িয়েছে, আধুনিকতার দিকে এগিয়েছে মানুষ। বদলে নিয়েছে তার পরিপার্শ্বকেও। এই আধুনিকরণ থেকে বাদ পড়েনি এশিয়ার দীর্ঘতম তথা বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী ইয়াং সিকিয়াং-ও। তার বুকের ওপরেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাঁধ ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’। তবে এহেন নির্মাণের মাশুল গুনতে হচ্ছে প্রকৃতিকে। এই ড্যামের কারণেই বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর কৌণিক গতি। বদলাচ্ছে দিনের দৈর্ঘ্যও।
হ্যাঁ, অদ্ভুত শুনতে লাগলেও বাস্তবেই এমন ঘটনার জন্য দায়ী চিনের ‘দ্য থ্রি গর্জেস’ ড্যাম। কিন্তু এই ঘটনার কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে বুঝতে হবে এই জলাধারের ভৌগোলিক অবস্থান। ‘থ্রি গর্জেস’ নামটির নেপথ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তা। ইয়াংসি কিয়াং নদী মূলত চিনের পার্বত্য উপত্যকার মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। আর সেই কারণেই নদীর গতিপথে রয়েছে অজস্র বাঁক। কোথাও কোথাও অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে এসেছে নদীর গিরিখাত। এমনই তিনটি গিরিসংকটের মাঝেই নির্মিত ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’।
পার্বত্য উপত্যকায় তৈরি এই বাঁধের উচ্চতা প্রায় ১৮৫ মিটার। আর জলতলের উচ্চতা ১৭৫ মিটার। তবে শুধু বাঁধ স্থাপন করলেই তো হয় না। দরকার হয় বিশাল জলাধারের। কিন্তু সংকীর্ণ গিরিসংকটের মধ্যে তেমন ব্যবস্থা কোথায়? ফলত, কৃত্রিম জলাধার তৈরির পন্থাকেই বেছে নিয়েছিলেন চিনের প্রযুক্তিবিদরা। ৬৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১.২ কিলোমিটার সেই চওড়া সেই জলাধারের ধারণ ক্ষমতা ৩৯.৩ ঘন কিলোমটার। আর এই পরিমাণ জলের ভার প্রায় ৪২০০ কোটি টন।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উচ্চতায় এই বিপুল পরিমাণ ভরের সংরক্ষণই দায়ী পৃথিবীর ভারসাম্য বিঘ্নিত করার জন্য। পদার্থবিদ্যার সূত্র অনুযায়ী, ঘূর্ণায়মান কোনো পদার্থের দূরত্ব তার অক্ষ থেকে যত বেশি হবে বাড়বে তার জড়তা ভ্রামক বা মোমেন্ট অফ ইনারসিয়া। সেই ঘটনাই ঘটে চলেছে থ্রি গর্জেস ড্যামের ক্ষেত্রে। সংরক্ষিত এই জলাধারের কারণে বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর জড়তা ভ্রামক। তার ফলে কমছে কৌণিক গতি। বেড়ে যাচ্ছে দিনের দৈর্ঘ্য। আর সেই দৈনিক পরিবর্তনের পরিমাণ ০.০৬ মাইক্রোসেকেন্ড। তবে শুধু দিনের দৈর্ঘ্যই নয়, এই ড্যামের কারণে পৃথিবীর মেরুর অবস্থানও সরে গেছে ০.৮ ইঞ্চি। লন্ডন, কান, অক্সফোর্ড-সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও নাসার খ্যাতনামা পদার্থবিদদের পৃথক পৃথক গবেষণায় উঠে এসেছে একই তথ্য। যদিও এই পরিবর্তন সামান্যই।
আরও পড়ুন
ভারসাম্য হারাচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্র, আশঙ্কায় বিজ্ঞানীরা
তবে শুধুই কি পৃথিবীর গতি পরিবর্তন? না, বরং মানব সভ্যতার কাছেও রীতিমতো ত্রাস এই নির্মাণ। বিশ শতকের একেবারে শুরুর দিকেই এই বাঁধ তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল চিন প্রশাসন। তার কারণ হল ইয়াংসি কিয়াং নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ। বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে দশকের পর দশক ধরেই সেই প্রকল্প পিছিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৩ সালে অনুমোদিত হয় এই প্রকল্পটি। জনকল্যাণমূলক এমন একটি উদ্যোগই ঘাতক হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাঁধ নির্মাণের এই প্রকল্প যে ‘ব্যাকফায়ার’ করবে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণই অবগত ছিল চিনের সরকার। শুধুমাত্র জলাধার তৈরির জন্যই ধ্বংস করা হয় ১১৪টি শহর ও দেড় হাজারেরও বেশি গ্রাম। সব মিলিয়ে বাসস্থান হারান ১৪ লক্ষ মানুষ। যারা মূলত কৃষক এবং মৎস্যজীবী। বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের উপার্জনের পথও। তবে পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ কোনোটাই পাননি তাঁরা। অভিযোগ ওঠে অর্থ তছরুপেরও। পাশাপাশি নিম্ন উপত্যকার বন্যা রোধ করা গেলেও, এই বাঁধের কারণে প্লাবিত হয় উচ্চ উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
আরও পড়ুন
কী আছে পৃথিবীর পেটের ভিতর? গর্ত খুঁড়লেন বিজ্ঞানীরা, তারপর...
মহাপ্রাচীরের পর ২০১২ সালে চালু হওয়া চিনের এই নির্মাণকেও দেখা যায় মহাকাশ থেকে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও গোটা বিশ্বের মধ্যে রেকর্ড তৈরি করেছে এই জলাধার। সব মিলিয়ে চিনের এই নির্মাণ এক বিস্ময়ই বটে। তবুও তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে হাজার বিতর্ক, সমালোচনা। যা হয়তো চলবে আগামীতেও…
আরও পড়ুন
বদলে গেল পৃথিবীর মানচিত্র, সমুদ্র-তালিকায় নতুন সদস্য দক্ষিণ মহাসাগর
Powered by Froala Editor