‘চ্যাটজিপিটি’— প্রযুক্তিই কি হয়ে উঠছে ব্যক্তিমেধার শত্রু?

কলকাতা থেকে কয়েকশো মাইল দূরের ছোট্ট শহর গিরিডি। সেখানে উস্রি নদীর তীরে বাস এক বাঙালি গবেষকের। তাঁর হাতেই জন্ম নিয়েছে আশ্চর্য সব যন্ত্র। কোনোটা অনায়াসেই মানবস্বরে অনুবাদ করে দিতে পারে পশুপাখিদের ভাষা, আবার কোনোটির মধ্যে রয়েছে জটিল ধাঁধাঁ বিচার করার বুদ্ধি, কঠিন থেকে কঠিনতম প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সাবলীল ক্ষমতা।

প্রোফেসর শঙ্কু। আজ থেকে পাঁচ দশক আগে যখন এই সিরিজ লেখা শুরু করেছিলেন সত্যজিৎ, তখন শঙ্কু সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বাঙালি পাঠকমহলে। এমনকি চলতি শতকের শুরুতেও শঙ্কুকাহিনি পড়ে গায়ের রোম খাড়া হয় যায়নি, এমন কিশোর-কিশোরী খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। তবে সত্যজিতের এই কল্পজগৎ বর্তমানে বইয়ের পাতা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বাস্তবে। আজ গোটা বিশ্বজুড়ে সমস্ত ক্ষেত্রেই রাজত্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। ধীরে ধীরে মানুষের বুদ্ধিমত্তাও যেন হার মানছে তার কাছে। আর তারই সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ‘চ্যাটজিপিটি’ (ChatGPT)।

৩০ নভেম্বর, ২০২২। ইন্টারনেটে মুক্তি পায় এই বিশেষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। নেপথ্যে ইলন মাস্কের সংস্থা, ‘ওপেন এআই’ (Open AI)। এই প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্পন্ন ‘চ্যাট বট’ প্রকাশ্যে এনেছে ‘ওপেন এআই’। যার সাম্প্রতিকতম সংস্করণ হল ‘চ্যাটজিপিটি’। তবে বাকিদের থেকে ‘চ্যাটজিপিটি’-কে আলাদা করে রাখে তার বিচক্ষণ ক্ষমতা, সৃজনশীলতা এবং যুক্তিবাদী ‘মগজ’। 

হ্যাঁ, ‘মগজ’-ই বটে। যে-কোনো সমস্যারই তাত্ত্বিক সমাধান দিতে সক্ষম চ্যাটজিপিটি। গাণিতিক সমস্যার সমাধান থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ— এই কৃত্রিম বুদ্ধমত্তার কাছে শরণাপন্ন হলে, উত্তর পাওয়া যায় সবকিছুরই। যেমন ভদ্র ভাষায় কারোর সঙ্গে কথা বলতে পারে সে, তেমনই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে লিখে দিতে পারে চিঠি। কিছুদিন আগেই ঘটেছে এমন এক ঘটনা। খোদ বিমান সংস্থাকে খারাপ পরিষেবা প্রদানের জন্য কড়া অথচ ভদ্র ভাষায় চিঠি পাঠিয়েছিলেন এক মার্কিন ভদ্রমহিলা। তবে সেই চিঠি তাঁর লেখা নয়। লেখক— ‘চ্যাটজিপিটি’। চিঠি তো দূরের কথা, ইতিমধ্যেই অনলাইন স্টোর আমাজনে পাওয়া যাচ্ছে এমন অসংখ্য বই, যেগুলির লেখক কিংবা সহলেখক ‘চ্যাটজিপিটি’। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়, দুশোরও বেশি। 

আশ্চর্য এই ‘চ্যাটবট’ মুক্তি পাওয়ার পর পেরিয়ে গেছে আড়াই মাস। ক্রমশই বেড়ে চলেছে তার জনপ্রিয়তা। ইতিমধ্যেই ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ কোটি। আর তা হবে না-ই বা কেন? বইপত্র ঘাঁটা, গুগল সার্চ করা কিংবা ভিডিও দেখার মতো কোনোরকম কসরত ছাড়াই যদি ‘হাতে গরম’ তথ্য, ব্যাখ্যা, তত্ত্ব মানুষের হাতে চলে আসে— তবে খাটাখাটনির ঝক্কি যে নিমেষে কমে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। আপাতদৃষ্টিতে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব এবং ক্ষমতা মন্ত্রমুগ্ধকর হলেও, সভ্যতার সর্বনাশ ডেকে আনছে ‘চ্যাটজিপিটি’। এমনটাই দাবি বিশেষজ্ঞদের একাংশের। কিন্তু কীভাবে?

একটু খুলে বলা যাক ব্যাপারটা। এতদিন পর্যন্ত বহু ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন এজেন্সি এবং অন্যান্য সংস্থারা নিবন্ধ লেখার কাজ করতেন বহু মানুষ। তাঁদের কাজ হারানোর কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে ‘চ্যাটজিপিটি’। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে গবেষক, কম্পিউটার প্রোগ্রামার, সাহিত্যিক কিংবা অন্যান্য সৃজনশীল ক্ষেত্রের কর্মীদের নিয়েও। কেন-না, অনায়াসেই গবেষণাপত্র লিখে দিতে সক্ষম ‘চ্যাটজিপিটি’। দীর্ঘ, জটিল কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখে দেওয়া কিংবা কবিতা-নাটক-উপন্যাস লেখাও তার কাছে দুরূহ কাজ নয় মোটেই। সবমিলিয়ে মানুষের সমস্ত গর্বকেই খণ্ডাতে চলেছে এই উত্তরাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ফলে, আগামীদিনে ‘চ্যাটজিপিটি’-র দৌরাত্ম্য বেকারত্বের মাত্রাকে আরও বাড়িতে দেবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। 

সবমিলিয়ে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ‘চ্যাটজিপিটি’ নিয়ে বিতর্ক চলছে গোটা বিশ্বজুড়েই। এমনকি ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নিষিদ্ধ করেছে এই চ্যাট বটের ব্যবহার। তবে ‘চ্যাটজিপিটি’-র ব্যবহার আটকানোটাও সহজ ব্যাপার নয় মোটেই। কোনো সৃজনশীল লেখার ক্ষেত্রে লেখক এবং প্রকাশক উভয়ের কাছেই থাকে আইনি স্বত্ব। প্ল্যাগারিজম বা অনুকরণের ক্ষেত্রে আইনি পথে হাঁটতে পারেন তাঁরা। তবে ‘চ্যাটজিপিটি’ সে-পথে হাঁটে না একেবারেই। বরং, তাঁর সৃষ্টি বাজার-চলতি বা আগে প্রকাশিত সমস্ত লেখার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনো একটি উত্তর পছন্দ না হলে, একই বিষয়কে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে দিতে পারে সে। ফলে, কোনো লেখা, প্রবন্ধ বা গবেষণাপত্র আদৌ তার লেখা নাকি মানুষের— তা নির্ধারণ করাও বেশ কঠিন কাজ। 

অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এই লড়াই আরও কঠিন হতে চলেছে আগামীতে। মাইক্রোসফটের সঙ্গে ইতিমধ্যেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন ইলন মাস্ক। আগামীতে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, পাওয়ারপয়েন্ট, এক্সেলের মতো সফটওয়্যারেও যুক্ত হচ্ছে ‘চ্যাটজিপিটি’। অর্থাৎ, এমএস-ওয়ার্ড খুলে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নির্দেশ দিলেই সোনা ফলাবে সে। হাতের মুঠোয় এনে দেবে গোটা পৃথিবী। অন্যদিকে ‘চ্যাটজিপিটি’-র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ময়দানে নামছে গুগল-ও। শুরু হয়েছে বিকল্প কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির গবেষণা। বলার অপেক্ষা থাকে না, আগামীদিনে ‘চ্যাটজিপিটি’ ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী ‘চ্যাট বট’-এর এই ডুয়েল লড়াইয়ে আখেরে মাশুল গুনতে চলেছে অর্থনৈতিক পিরামিডের মধ্য ও নিচুর তলার মানুষরা। ‘আশীর্বাদ’ হয়ে ‘অভিশাপ’ উঠতে চলেছে সভ্যতার কাছে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More