উৎসবের মেজাজ ফিকে, ক্রিসমাসের আগের দিনেও বিষণ্ণ কলকাতার অ্যাংলো-পাড়া

‘ডিওন? নাও, হোয়ার দ্য হেল ডিড দ্যাট গার্ল গো?’
‘রবার্ট হেল্প হার। হোয়াই আর ইউ স্মোকিং লেজিবোনস?’
‘ব্রিং দ্য ক্যান্ডলস। হারি আপ।’

গলির দু'পাশে সারি সারি লাল বাড়ি। আলোয় আলোয় ঢেকে গিয়েছে। সাদা চিনা লণ্ঠন আর সস্তার টুনি। রাস্তার মাঝে পেল্লায় ক্রিসমাস ট্রি। তখন সন্ধ্যা হব-হব। জোরকদমে প্রস্তুতি চলছে। ম্যাডাম ডি সিলভা, ড্রেসিং গাউন পরে সিগারেট টানছেন। চোখে কঠোর দৃষ্টি। রাস্তার দু'পাশের ফুটপাথে বসবে দুটো স্টল। সেখানে মোমো,  ভাজা ওয়ানটন, আর চিকেন পন্থরাস মিলবে গরম গরম। রয়েছে ক্রিসমাস কেক আর রাম-বল। বাড়িতে বানানো সাহেবি মিষ্টি। আর ডিয়ন-‘ম্যাম’কে ফিসফিসিয়ে শুধোলেই পেয়ে যাব দু-ধরণের ওয়াইন। আদা আর আঙুরের অপূর্ব সুধা। 

রবার্ট আলেকজান্ডার ঈষৎ গলা খাঁকারি দিলেন, আমায় দেখে। সেই বিকেল তিনটের সময় পৌঁছে গিয়েছি বো-ব্যারাক। বৌবাজার থানার পেছনের গলি ধরে খানিক হেঁটে বাঁদিক ঘুরলেই। তিনটে থেকে ছ'টা বাজতে চলল, দাঁড়িয়েই আছি। মাঝে মাঝে অস্থির পায়চারি। এবার সবকিছু কেমন যেন শুনশান। কেউ কোত্থাও নেই। বিকেল চারটে থেকে অল্প অল্প করে লোক জমছে রাস্তায়। দোকান সাজাতে নেমেছেন মহিলারা। হাঁকডাক শুরু হয়েছে। ম্যাডাম ডিসুজা কড়া নজরে তদারক করছেন। মি: রবার্ট, তাঁর আধা-ঘোলাটে চোখে মাপছিলেন আমায়।
‘সো ইয়ং ম্যান, হোয়াট ব্রিংস ইউ হিয়ার?’
পরিচয় পেয়ে, আক্ষেপের চুকচুক শোনা যায়।

‘হমে তো বাংলা নেহি আতা। হম তো ইউ নো হোয়াট আই মিন...’ বাক্য শেষ হতে না হতেই দরাজ গলায় দিলখোলা হাসি। সে হাসির আওয়াজ যেন বেথেলেম পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। নিজের ‘এংলো ইন্ডিয়ান'পনা নিয়ে রসিকতা করার সুযোগ সামলাতে পারেন না রবার্ট। 

আরও পড়ুন
ইংল্যান্ডে করোনা-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, বাতিল বড়োদিনের উৎসবও

বো-ব্যারাকে এখন প্রায় ১৩২টি পরিবার বাস করে। তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। কেউ ভাড়া-টাড়া দেন না। বাড়িগুলি এখন কলকাতা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের অধীনে। অনেকে চাকরি করেন, কেউ ব্যবসা। তবে এই জমি ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার চিন্তা-টিন্তা নেই। কোনো তাগিদও নেই। প্রতি ক্রিসমাসে বো-ব্যারাকের ধুমধাম কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ। সারা গলি মুড়ে যায় আলোয়। ২৩ তারিখ হল ‘মিউজিক্যাল নাইট’। ব্যারাকের যুবদের নিজস্ব ব্যান্ড। কচি কাঁচাদের পারফরম্যান্স হয়। ব্যারাক বাদ-দিয়েও বৌবাজারের নানা কচিকাঁচা জড়ো হয় গলিতে। প্রায় সাতশো খোকাখুকু। এরমধ্যে পথশিশুদের মুখে ব্যারাকের অধিবাসীরা তুলে দেন রুটি কিংবা কেক। বাইরে থেকে শিল্পীও আসেন। পারফরম্যান্স চলে সারারাত। সেই সঙ্গে হই-হুল্লোড়-পানসি-বেলঘরিয়া। বাড়িতে বানানো কেক-পেস্ট্রি ভাগ করে নেন ‘ব্যারাকে’র সকলে। শিশুরা খামে ভরে পাব্বুনি পায়। ২৪ তারিখ ‘মাস’। ক্রিসমাস ইভ। আর ২৫শে সান্তা ক্লজের আগমন।
‘ইয়ু হ্যাভ কাম এট এ রং টাইম ম্যান। অব তো কুচ নেহি হোগা।’

আরও পড়ুন
৮০০ বছরে সবচেয়ে কাছাকাছি বৃহস্পতি ও শনি, বড়োদিনের ‘বড়ো’ উপহার

রবার্ট-এর গলায় বিষাদের সুর। ফুটপাথের ওপর সারি সারি প্লাস্টিকের টুল। তার একটাতে বসে রবার্ট শুকনো মুখে সিগারেট ফুঁকছেন। খানিক দূরেই টেবিল। তার পাশে স্টোভের আঁচে বিরাট কড়াইতে ফুটছে তেল। সেখানেই ভাজা চলছে চিকেন পন্থরাস। ভাজছেন মিস গ্লেনা। মা ও মেয়ে দোকান চালান। প্রতি ক্রিসমাসে নিজে হাতে বানান রাম বল আর কেক।
‘বিজনেস ইজ কাইন্ডা ব্যাড রাইট নাও। বিকজ অফ দিস ড্যাম প্যান্ডামিক।’

আরও পড়ুন
গরিব শিশুদের খেলনা উপহার ৮০ বছরের বৃদ্ধের, বড়দিনের ‘সান্টাক্লজ’ তিনিই

বলছিলেন রবার্ট। আত্মীয়-বন্ধুদের অনেকেই থাকেন অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে। ফি-বছর ফ্লাইট ধরে ঘরে ফেরা। এ-বছর সমস্ত ফ্লাইট বন্ধ। কেউ আসতে পারছেন না। ক'দিন আগেই করোনা থাবা বসিয়েছে ব্যারাকে। ফলে পুলিশ কড়া নজরদারি চালাবে। বহিরাগতদের আনাগোনা খানিক নিয়ন্ত্রণেও থাকবে। কিন্তু করোনার কারণে উৎসবের আমেজ এক্কেবারে মাটি। ব্যারাকের বাসিন্দাদের কাছে তো যিশু-পরব, প্রায় দুর্গাপুজোর সমান। সেই উদযাপনে আজ ভাঁটা পড়েছে রাতারাতি। ক্রিসমাসকে কেন্দ্র করে ব্যারাকবাসীদের জীবিকাতেও টান পড়েছে। 

গলির একপ্রান্তে ‘হুলা-হুপ’ গায়ে জড়িয়ে ছোটাছুটি করছিল ছোট্ট ক্রিশ্চিনা। ছলছল চোখে বলে,
‘ড্যাড সেড, নো-বডি গোননা কাম টুমরো। আই ওয়ান্ট টু প্লে উইথ মাই বাডিস…’
লাল বাড়ি বাড়ি ঘেরা গলিটা দিয়ে বেরোনোর সময় শুনতে পেলাম, একটা লাউডস্পিকারে মৃদুস্বরে বাজছে, ‘সাইলেন্ট নাইট’।
এবারের বড়োদিন, বড়োই দীন।

ছবি ঋণ - অনিতেশ চক্রবর্তী, ছন্দক গুহ

Powered by Froala Editor