তিনকুলে নেই কেউ, 'অন্যরকম' এক ভাইফোঁটার গল্প কলকাতার বুকে

কেউ হয়তো দাঁড়াতে পারেন না ভালোভাবে। কারোর আবার ভাইফোঁটা কী জিনিস, সেই ধারণাই গড়ে ওঠেনি পুরোপুরি। তবু তাঁরা ফোঁটা দেন। সার দিয়ে বসে থাকা ‘ভাই’দের কপালে ছুঁইয়ে দেন ঘি-চন্দনের ফোঁটা। প্রার্থনা জানান, যমের দুয়ারে যেন কাঁটা পড়ে। ভাইয়েরা যেন কোনো বিপদের মুখোমুখি না হয়।

প্রায় তিরিশ বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে সল্টলেকের প্রবর্তক সংঘে। ভাইফোঁটার এই দিনটিতে পরস্পর আনন্দে মেতে ওঠেন সেখানকার আবাসিকরা। ফোঁটা দেওয়ার পর, সকালে লুচি-আলুর দম। দুপুরে পেট পুরে মাংস-ভাত। সমাজের বাইরে এ যেন এক নতুন সমাজ। যেখানে কোনো দাবি নেই, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নেই, থাকার মধ্যে শুধু মঙ্গলকামনা।

১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রবর্তক সংঘের সল্টলেক শাখা। মূল প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য চন্দননগরে ১৯২৫ সালে স্থাপিত হয়, মতিলাল রায়ের উদ্যোগে। ব্রিটিশ ভারতে সমাজসেবা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভূমিকা ছিল এই প্রতিষ্ঠানের অখণ্ড ভারতের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিতও হয় এর শাখা। সেসব অবশ্য ইতিহাস।

আশির দশকে সল্টলেকের এই শাখা চালু হলে, বিভিন্ন জায়গা থেকে অনাথ, পরিত্যক্ত, মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের এখানে নিয়ে আসা হয়। তবে সেই লড়াই অতটা সহজ ছিল না। কারোর হয়তো মা-বাবা নেই, পথে পড়ে আছে একা। আবার কাউকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে, আর খোঁজ নেননি অভিভাবকরা। প্রবর্তক নিজেদের উদ্যোগে তাদের নিয়ে এসেছে এই হোমে। কখনও আবার সরকারের তরফ থেকেই পাঠানো হয়েছে আবাসিকদের। এভাবেই তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই আশ্রম। এখন আবাসিকের সংখ্যা ৫২ জন। এর মধ্যে ৩৮ জন ছেলে ও ১৪ জন মেয়ে। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি দেখাশোনার ভার পালন করে চলেছে প্রবর্তক সংঘ, ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতীপুজোয় একসঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন আবাসিকরা। ভাইফোঁটার দিনও বাদ পড়ে না। শম্ভু, অর্জুন, উদয়, মনোজ, প্রশান্ত, সমীররা সার দিয়ে বসেন মেঝেতে। ফোঁটা দেন বাসন্তী, তিথি, স্বপ্নারা। তাঁদের পদবি নেই। কারো কারো নাম প্রবর্তকেরই দেওয়া, কেউ আবার সরকারের দেওয়া নাম বহন করেন। পদবি নেই কারোরই। দরকারও নেই হয়তো। সমস্ত বিভাজনের ঊর্ধ্বে নামই হয়ে ওঠে তাঁদের একমাত্র পরিচয়। তাঁরা জানেন, তাঁদের আর কোথাও যাওয়ার নেই। এই আবাসনই তাঁদের ঠিকানা, তাঁদের একমাত্র আশ্রয়। জন্মসূত্রে পাওয়া পরিবার হারিয়ে, নতুন পরিবার গড়ে উঠেছে এখানেই। ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে সেই আনন্দই বচ্ছরকার এই দিনে ভাগ করে নেন তাঁরা।

অলক্ষ্যে কি কোথাও হেসে ওঠেন যম-যমীও?