গভর্নরকে গুলি ছুঁড়ে গ্রেপ্তার মেয়ে, চলছে অকথ্য নির্যাতন; মুখ খোলেননি পিতা বেণীমাধব

কটকের র্যা ভেন শ কলেজিয়েট স্কুলের করিডোরে হেঁটে বেড়াচ্ছে এক বালক। চোখ মুখ থেকে বিস্ময় তখনও যায়নি তার। স্কুলে সাহেবি পোশাক পরিহিত ভারতীয়, কখনও আস্ত সাহেবদের দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। বাড়িতে মামাকে দেখেছে সে; মস্ত বড়ো অ্যাটর্নি জেনারেল তিনি। একদিন সেও বড়ো পদমর্যাদায় চাকরি করবে, সাহেবদের মতো পোশাক পরে আপিসে যাবে— এমনই ছিল আশা। স্বপ্ন যখন প্রায় নিজের অট্টালিকা তৈরি করে ফেলার মুহূর্তে, তখনই সে দেখল ধুতি-চাদর পরা একজন মানুষকে। র্যা ভেন শ স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনি। শুধু শিক্ষায় নয়, সমস্ত দিক থেকে ভারতীয়দের এগোতে হবে, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে দেশকে— এমনই স্বপ্ন ছিল মানুষটার। ব্রিটিশদের গোলামি নয়, তাঁদের চোখের দিকে চোখ রেখে উত্তর দিতে হবে অপমানের। র্যা ভেন শ স্কুলের সেদিনের শিক্ষক বেণীমাধব দাসকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ছোট্ট ছেলেটা। স্বপ্নে ক্রমশ বেড়ে ওঠা অট্টালিকা ভেঙে যায় অচিরেই; বদলে তৈরি হয় জাতীয়তাবাদের বৃক্ষ। যেখানে নিজেকেই নিজেকে দীক্ষিত করলেন সেদিনের ছোট্ট বালক, সুভাষচন্দ্র বসু… 

সুভাষ বসুকে নিয়ে গোটা ভারত আজও সংবেদনশীল। হবে নাই বা কেন, তিনি যে আমাদের সবার নেতাজি! কিন্তু নেতাজির দীক্ষাগুরুর কথা ক্রমশ পিছনে রয়ে গেছে। বিখ্যাত ছাত্রের নামের পাশে টিমটিম করে জ্বলছেন বেণীমাধব দাস। অথচ তিনিই ছিলেন ধ্রুবতারা। আগুন জ্বালানোর মশলাটা তো তিনিই জুগিয়ে দিয়েছিলেন! সাহেবদের অন্ধ অনুকরণ থেকে দেশের প্রতি ভালোবাসা— সুভাষের এই পরিবর্তন আসত না, যদি এই মানুষটা না থাকতেন। 

চট্টগ্রামের বাসিন্দা তিনি। সেই চট্টগ্রাম, যা একসময় ব্রিটিশ শক্তির মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। দর্শন, অর্থনীতি, ইতিহাস— এই সমস্ত নিয়েই ছিল তাঁর পাণ্ডিত্যের জগৎ। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। প্রায় একার চেষ্টায় চট্টগ্রাম কলেজকে শিখরে তুলে ধরেছিলেন। অনেকের মতো একটা সময় আকৃষ্ট হন ব্রাহ্ম ধর্মে। ‘নববিধান’ এবং ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’— ব্রাহ্মদের এই দুটো পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন তিনি। ভাগ্যের ফেরে কলকাতা, চট্টগ্রাম থেকে হাজির হওয়া ওড়িশার কটকে। তখনও কি ভেবেছিলেন, জীবনের সেরা ছাত্রটিকে এখানে পাবেন… 

সুভাষের মেধা, বুদ্ধি নিয়ে প্রথম থেকেই কোনো সংশয় ছিল না বেণীমাধব দাসের। এতদিনের শিক্ষক জীবনের অভিজ্ঞতা তো বিফলে যেতে পারে না। আর হলও তাই! ক্ষুরধার সুভাষ প্রতিবারই প্রথম হতেন। তবে ভেতরে ভেতরে যে আরও পরিবর্তন ঘটে চলেছে! যে সুভাষ এতদিন কোট-প্যান্ট পরে যাওয়ার কথা ভাবতেন, স্বপ্ন দেখতেন সাহেবদের মতো থাকার; সে-ই কিনা ধুতি আর জামা পরতে শুরু করলেন! ক্লাসের আর কেউ তখন এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহসই পায়নি। ততদিনে তাঁর মনোজগতে প্রভাব ফেলেছেন বেণীমাধব স্বয়ং। বিবেকানন্দের বই পড়তে দিতেন সুভাষকে, ক্লাসে বলতেন গ্যারিবল্ডি, নেপোলিয়নদের কথা। আর সুভাষ সবসময় ছুটে যেতেন তাঁর প্রিয় শিক্ষকের কাছে। শরৎচন্দ্র বসুকেও পড়িয়েছিলেন বেণীমাধব। দুই ভাইয়ের ভেতরেই স্বাধীনতার বীজটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ক্ষুদিরামের ফাঁসির পর তৃতীয় শহিদ দিবসে সুভাষের নেতৃত্বে একটি দল ঘরে ঘরে অরন্ধন কর্মসূচি পালন করে। বেণীমাধব দাস খুশিই হয়েছিলেন এতে। কৃষ্ণনগরে বদলি হয়ে চলে যাওয়ার পর যখন সুভাষচন্দ্র বসু’র অস্থিরচিত্তের খবর পেলেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরিচিত একজনকে পাঠিয়ে দিলেন সেখানে। ভবিষ্যতের রূপটা দেখতে পেয়েছিলেন কি? 

আরও পড়ুন
তখনও পরাধীন ভারত; ইংরেজদের হটিয়ে বাংলাতেই জন্ম নিয়েছিল দুটি ‘স্বাধীন’ সরকার

শুধু কি ছাত্রদের মধ্যেই প্রভাব ফেলেছিলেন তিনি? বাড়ির ভেতরেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশাত্মবোধ। সন্তানরা যখন বিপ্লবী কাজকর্মে জড়িয়ে ফেলে নিজেদের, তখনও সম্পূর্ণ সমর্থন করে এসেছেন তিনি। মেজছেলেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় বেণীমাধব দাসের দুই মেয়ের কথা। বড়ো মেয়ে কল্যাণী দাস তো যুক্ত ছিলেনই নানা বিপ্লবী কাজের সঙ্গে। তবে সবথেকে দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তাঁর ছোটো মেয়ে বীণা দাস। ১৯৩২ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। মঞ্চে উপস্থিত তৎকালীন গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন। মঞ্চে উঠে পুরস্কার নেওয়ার সময় লুকিয়ে রাখা পিস্তল থেকে তাঁর দিকে গুলি করেন বীণা দাস। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মারা যাননি গভর্নর। বীণার ওপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়। শেষে বেণীমাধববাবুকেও ডেকে পাঠানো হয় মেয়েকে বোঝানোর জন্য। একটাই উদ্দেশ্য, এই পিস্তল কোথা থেকে পেল মেয়েটি। কিন্তু পুলিশ তো জানে না বেণীমাধব দাস ঠিক কেমন ধারার মানুষ! পুলিশকে সহযোগিতা তো করলেনই না; বরং মেয়েকে আরও সাহস দিলেন। বাহবা দিলেন এমন কাজ করার জন্য। বীণাও এমন ভরসার হাত পেয়ে আরও জ্বলে উঠলেন। ব্রিটিশদের প্রতিবাদে বেণীমাধব নিজেই লিখলেন ২৫ পাতার লম্বা একটি বিবৃতি। এই সাহেবদের কাছে কোনোমতেই মাথা নত করা চলবে না… 

শেষ পর্যন্ত নয় বছর কারাবরণ করে বীণা ছাড়া পান। নিজের চোখে স্বাধীনতা দেখে গিয়েছিলেন বেণীমাধব দাস। কিন্তু যা দেখতে চেয়েছিলেন, তা আর দেখা হয়নি। একটা গোটা দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সেই সঙ্গে বাংলার বুকে জ্বলে উঠল দাঙ্গার আগুন। ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড কুইট’ নীতির জালে এত সহজে পড়ে গেলাম আমরা! নোয়াখালি, কলকাতা— সব জায়গায় পড়ে আছে একের পর এক মৃতদেহ। মানুষ মানুষকে মারছে, আর তার ওপর দিয়েই আসছে স্বাধীনতা! ১৯৫২ সালের ২ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সেই আঘাত শরীরে-মনে নিয়ে রেখেছিলেন বেণীমাধব দাস। আর প্রিয় ছাত্রের নিরুদ্দেশ হওয়ার খবরের পর তাঁর প্রতিক্রিয়া? জানা যায়নি কখনও… 

আরও পড়ুন
কলকাতার নাম বদলে হল ‘আলিনগর’, ইংরেজদের শহর থেকে তাড়িয়ে ছাড়লেন সিরাজ

Powered by Froala Editor

More From Author See More