বিয়ের পিঁড়ি ছেড়ে ভিকট্রি স্ট্যান্ড – তিরন্দাজিতে সোনা বাংলার কিশোরীর

লড়াইকে বুকে নিয়েই যেন জন্মেছে সে। মাত্র চোদ্দ বছর বয়েস। এই বয়েসে আর পাঁচজন মেয়ে যেভাবে বেড়ে ওঠে, তা তার কপালে ছিল না। সুযোগ হয়নি বান্ধবীদের মতো মেয়েবেলা কাটানোও। কিন্তু এই বয়েসেই বিয়ের পিঁড়িকে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে বদলে দিয়েছে তবসসুম খাতুন ইতি।

অবিশ্বাস্য এই সত্যিকেই জীবন দিয়ে চিনেছে বাংলাদেশের এই কিশোরী। নেপালের পোখরাতে অনুষ্ঠিত ১৩তম দক্ষিণ এশিয় গেমসে তিরন্দাজিতে সোনার হ্যাটট্রিক করা ইতি জানতও না, তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভুটানি তিরন্দাজ এরই মধ্যে পেয়ে গিয়েছে টোকিও অলিম্পিকের টিকিট। ইতি শুধু চিনে নিয়েছিল লক্ষ্যটুকু। ভুটানি সেই তিরন্দাজকে ৬-০তে হারানো, দলগত ও মিক্সড ইভেন্টে সোনা জেতা মেয়েটিকে হয়তো খুঁজেই পাওয়া যেত না, যদি বছর তিন আগে বিয়েতে রাজি হয়ে যেত সে।

বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গার বেলগাছির মুসলিমপাড়া এলাকার ইবাদত আলীর মেয়ে ইতি। তখন সে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। দারিদ্র্যকে সঙ্গে নিয়ে বড় হতে চলা মেয়েটি হঠাৎ একদিন শুনল, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। প্রবল অর্থকষ্টে তিন মেয়ের খরচ চালাতে না পেরেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইবাদত। কিন্তু সেদিনকার ইতিও লক্ষ্যে অবিচল ছিল। নিজের বাল্যবিবাহে জল ঢেলে পালিয়ে যায় ইতি। যোগ দেয় চুয়াডাঙ্গার তিরন্দাজির প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে।

ছোট থেকেই অসম্ভব উজ্জ্বল ইতির চোখে সাফল্যের খিদেটুকু দেখেছিল অনেকেই। কিন্তু আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা দারিদ্র্যকে পেরোতে পারছিল না সে। অবশেষে কর্মসূচিতে অভাবনীয় সাফল্যের পর ইতিকে জাতীয় স্তরে তুলে আনে বাংলাদেশ তিরন্দাজ সংসদ। ২০১৮তে জাতীয় স্তরে প্রথম পদক ইতির। এরপর তিরন্দাজ সংসদের হয়েও ব্রোঞ্জ পেয়েছিল এই বিস্ময় বালিকা। একের পর এক নিশানা ভেদ করে ইতি এখন দক্ষিণ এশিয়া গেমসের সেরা তিরন্দাজ।

বাংলার সোনার মেয়েকে নিয়ে তার বাবা-মায়ের গর্বেরও অন্ত নেই। মেয়ের সাফল্যে বাকরুদ্ধ বাবার চোখে জল আর অপরাধবোধ। বাল্যবিবাহের আয়োজন করা এই মানুষটিই আজ কোন বাবাকেই মেয়ের বাল্যবিবাহ না দেওয়ার আবেদন করছেন সর্বসমক্ষে। বাংলাদেশের প্রত্যন্তে অনিয়মই একপ্রকার আইনের পর্যায়ে। সেখানে ইবাদতের এই কথা দেশের নারী সুরক্ষার চেতনাকে কতটা এগোবে আগামীদিনই বলতে পারবে। কার্যত আনন্দের জোয়ারে ভাসছে স্কুল শিক্ষক, সহপাঠী বান্ধবী থেকে গোটা চুয়াডাঙ্গাবাসী।

বাংলাদেশের তিরন্দাজিতে তথা গ্রামীণ ক্রীড়া মানচিত্রে ইতি যে পাকাপাকি জায়গা করে নিল, তা বলাই বাহুল্য। সঙ্গে এটাও দেখার, ইতিকে সামনে রেখে কতটা বদলায় বাংলাদেশের সামগ্রিক ক্রীড়া ব্যবস্থা।