খ্যাতির মধ্যগগনেও লোকাল ট্রেনের ভিড়ে মিশে যেতে পারতেন ব্যারেটো

হোসে র‍্যামিরেজ ব্যারেটো। মোহনবাগানের নয়নের মণি। তাঁর পায়ের জাদুতে একসময় মেতে উঠেছিল আপামর মোহনবাগানী। ব্রাজিলের এই খেলোয়াড় সবুজ-মেরুন জার্সিতে বিপক্ষের ত্রাস। পায়ে একবার বল পড়লেই, নিখুঁত পাস কিংবা দুরন্ত শটে কীভাবে যে জালে বল পাঠিয়ে দিতেন, তা দর্শকদের কাছে বিস্ময় ছিল। 'সবুজ তোতা' একদিনে হননি তিনি। তাঁর বিনয়ী স্বভাবও অনেকের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল তাঁকে।

২০১২ সাল। তখন আমার কলেজের সেকেন্ড ইয়ার। বেলঘরিয়া থেকে রোজ সকাল ৮.৪৭-এর কল্যাণী সীমান্ত লোকাল ধরে যাই কলেজে। সেই ট্রেন মিস হলে, ৯.০৫-এর শান্তিপুর লোকাল। সম্ভবত অক্টোবরের কোনও এক দিন ছিল সেটা। কল্যাণী সীমান্ত না পেয়ে, উঠেছি শান্তিপুর লোকালে। স্বভাববশত দাঁড়িয়ে আছি উল্টোদিকের দরজায়। মৃত্যু কীভাবে ব্যালেন্সের সামান্য ভুলের অপেক্ষা করে থাকে, রোজ তার পরীক্ষা হয়ে যেত, না চাইতেও।

হঠাৎ ট্রেনের ভেতরে মন যেতে, চমকে উঠলাম। ফিসফিস করে সবাই বলছে 'ব্যারেটো, ব্যারেটো!' মাথা ঘুরিয়ে দেখি, সিটে বসে আছেন স্বয়ং সবুজ তোতা। পাশে আরেক ফুটবলার, নিমা। ব্যারেটো কখনও কাগজ পড়ছেন, কখনও হেসে কথা বলছেন নিমা-র সঙ্গে। কখনও আবার হাত নাড়ছেন উচ্ছ্বসিত যাত্রীদের দিকে।

সে-বছরই মোহনবাগান ছেড়ে দিয়েছিলেন ব্যারেটো। যোগ দিয়েছিলেন সম্ভবত ভবানীপুর এফসি-তে। সেই দলের হয়েই কল্যাণীতে খেলতে যাচ্ছিলেন তিনি। অবাকভাব তখন ক্রমশ গ্রাস করছে আমায়। ব্যারেটোর মতো খেলোয়াড়, যিনি এতদিন বিশাল সংখ্যক বাঙালির নয়নের মণি ছিলেন, তিনি কিনা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো শান্তিপুর লোকালে চেপে খেলতে যাচ্ছেন! খারাপলাগার পাশাপাশি, ভবানীপুর এফসি ক্লাবটার ওপর রাগও হয়েছিল সেদিন, অস্বীকার করে লাভ নেই।

তখন স্মার্টফোনের চল হয়নি বিশেষ। নিজেদের সাধারণ ফোনেই ব্যারেটোর ছবি তুলছিলেন অনেকে। আমিও তুললাম। খানিক ঝাপসা, খানিক কাঁপা। ব্যারেটো হাসছেন। কাগজ পড়ছেন ব্যারেটো। উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন ভিড়ের দিকে।

আরও অনেকের মতো, আমিও তাঁর দিকে এগিয়েছিলাম খাতা, অটোগ্রাফের জন্য। সেই অটোগ্রাফ এখনও আমার কাছে আছে। হলুদ রঙের খাতা, যার সামনের দিকের পাতাগুলো হাঁসফাঁস করছিল থেভনিন থিয়োরেম আর স্টার-ডেল্টা কানেকশনের জালে পড়ে, তারই পেছন পাতায় সই দিয়েছিলেন সবুজ তোতা। ইঞ্জিনিয়ারিং যেন সেই মুহূর্তেই সবুজ ময়দানে পৌঁছে গিয়েছিল, আজ মনে হয়।

এক বন্ধু আমায় একবার জিজ্ঞেস করেছিল - 'বল তো, ফিউজ কী?' উত্তর দিয়েছিলাম, 'ওই তো, যা উড়ে যায়!' ততদিনে কি সবুজ তোতা বাসা বেঁধে ফেলেছিলেন আমার বইখাতার মধ্যে? আজ আর মনে নেই...