শুধু দেশদ্রোহিতা-সংক্রান্ত নয়, বাতিল হোক ইউএপিএ-সহ সমস্ত আইনই

দেশের সর্বোচ্চ আদালত, একটি বৈপ্লবিক রায় দিয়েছেন। সবাই দুহাত তুলে এই রায়ের প্রশংসা করছেন, বলছেন এই এত দিনে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সরকারকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করল। এই ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বা ‘রাজদ্রোহ’ (Sedition) আইনটিকে স্থগিতাদেশ দেওয়ার অর্থ কী? তাহলে কি এই আইন যাঁদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে, সেই প্রায় চোদ্দ হাজার মানুষ কালকেই মুক্তি পেয়ে যাবেন? ব্রিটিশ শাসনকালে ১৮৬০ সালে তৈরি হয় আইপিসি অর্থাৎ ইন্ডিয়ান পিনাল কোড, তারও বিশ বছর পরে, যুক্ত করা হল ১২৪ এর ক ধারা। সেই ধারার বলে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার, মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জহরলাল নেহেরু সহ আরও বহু মানুষকে অভিযুক্ত করে। কথা ছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, এই আইন বিলুপ্ত হবে, অথচ অদ্ভুতভাবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পঁচাত্তর বছর হয়ে গেছে স্বাধীনতার, আমরা উদযাপন করছি, একদিকে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ আর ওদিকে একের পর এক সরকার বিরোধী মুখকে কারাগারের অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। মারা গেছেন অশীতিপর ফাদার স্ট্যান স্বামী, কারাগারে আটক হয়ে রয়েছেন অসংখ্য মানুষ। প্রমাণের অভাবে হয়তো মুক্তি পেয়েছেন কেউ কেউ, কিন্তু বেশিরভাগই এখনো আছেন কারাগারে। কিছু উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

আর্শিদ ইউসুফ, ইনায়েত আলতাফ শেখ, শৌকত আহমেদ গনাই, তিনজনেই কাশ্মীরি ছাত্র। নাম তিনটে শুনে প্রথমেই কী মনে হবে? একে মুসলমান, তায় কাশ্মীরি ছাত্র। তাহলে কি সন্ত্রাসবাদী? আরও একটু তথ্য যোগ করা যাক। এই তিন ছাত্রকে এলাহাবাদ উচ্চ আদালত কিছুদিন আগে জামিনে মুক্তি দিয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, গত ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর, ভারত এবং পাকিস্তানের যে টি-২০ ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছিল, তাতে পাকিস্তানের সমর্থনে সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেই সময়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, যে সমস্ত মানুষ এই ধরনের খেলায় পাকিস্তানের সমর্থন করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ আইনে মামলা করা হবে। তার প্ররিপ্রেক্ষিতেই উত্তরপ্রদেশের পুলিশ এই তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ দায়ের করা হয়। জাভেদ মিঁয়াদাদের ব্যাটিং বা আব্দুল কাদিরের বোলিং-এর প্রশংসা কি আজ থেকে দশ বছর আগেও দেশদ্রোহিতা ছিল? তা হলে আজ কেন এই অভিযোগে যে-কোনো মানুষকে গ্রেপ্তার করা হবে?  যেদিন এই তিন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেদিন দেশের প্রায় সমস্ত গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল, বারংবার টেলিভিশনের নানান চ্যানেলে উচ্চকিত বিতর্ক হয়েছিল। সমস্ত কাশ্মীরি মানুষই আসলে পাকিস্তানের সমর্থক, তা প্রমাণ করতে নানান স্তরের বিজেপির নেতারা টেলিভিশনের পর্দায় এসেছিলেন এবং উচ্চস্বরে বলেছিলেন, এই জন্যেই কাশ্মীর থেকে স্বায়ত্বশাসন তুলে নেওয়াটা জরুরি ছিল। কাশ্মীরি মানুষ মাত্রেই সন্ত্রাসবাদী এবং পাকিস্তানের সমর্থক, তাই তাঁদের কোনোরকম সহানুভূতি দেখানোটা অনুচিত।

এই তিন ছাত্রের গ্রেপ্তারির খবরে যেভাবে জাতীয়তাবাদের বন্যা বয়েছিল সারা দেশ জুড়ে, তাঁদের মুক্তির খবরে কিন্তু এর সিকিভাগ আলোচনাও হয়নি। তাঁদের মুক্তির সময়ে এলাহাবাদের উচ্চ আদালতের কিছু বক্তব্য সামনে এসেছিল। তাঁদের তরফে বলা হয়েছিল ভারতের ঐক্য এতটাও ঠুনকো নয়, যে, কোনো ফাঁপা শ্লোগানে তার ভিত নড়ে যাবে। হয়তো তাঁরা মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু এই তিন ছাত্রকে যেভাবে কালিমালিপ্ত করা হল,  যেভাবে এই ছাত্রদের সামাজিক সম্মান নষ্ট হল, তা কীভাবে ফেরত পাওয়া যাবে?

শুধু এই তিন কাশ্মীরি ছাত্র নয়, ২০১৪ থেকে আজ অবধি অন্তত ৫০০ জনের বিরুদ্ধে এই দেশদ্রোহিতার মামলা হয়েছে। যদিও দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে যে, যতদিন না এই বিষয়ে আদালত তাদের চূড়ান্ত রায় জানায়, ততদিন পর্যন্ত কোনো মানুষের বিরুদ্ধে আর এই অভিযোগ দায়ের করা যাবে না, কিন্তু সরকার কি আদালতের এই রায় মেনে চলবে? আগের বহু ক্ষেত্রেই যেখানে দেখা গেছে, আদালতের রায়কে তোয়াক্কা না করে, সরকার নিজের মতো করে নিজের কাজ চালিয়ে গেছে, এক্ষেত্রেও কি তার অন্যথা হবে? কেন হবে না, তা নিয়ে বরঞ্চ একটু আলোকপাত করা জরুরি। কীভাবে পুলিশের জন্যেই এই ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় একজন সাধারণ মানুষ, তার উদাহরণও প্রচুর আছে। কর্ণাটকের দুটি থানার ক্ষেত্রেই এই উদাহরণ আছে, কীভাবে পুলিশ বেশি দায়িত্বশীল হয়ে আগ বাড়িয়ে, একজন সাধারণ মেষপালকের ওপর এই দেশদ্রোহিতার অভিযোগ করেছে। সেই মেষপালক মানুষটি তৃতীয় শ্রেণি অবধি পড়াশুনা করেছে, প্রযুক্তিগতভাবে খুব বেশি আধুনিক তা বলা যায় না, তিনি হোয়াটসঅ্যাপ মারফত একটি বার্তা একজন দুজন মানুষকে পাঠান। ঘটনাচক্রে তা থানার কিছু পুলিশের নজরে আসে, তাঁরাই স্বতপ্রণোদিত হয়ে সেই যুবকটির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনেন। সেই ভিত্তিতে ওই যুবকটিকে ৪ মাস কারাগারে থাকতে হয়। পরে পুলিশ অবশ্য স্বীকার করে, তাঁদের পক্ষ থেকে যুবকটিকে ঐ অভিযোগে অভিযুক্ত করা ভুল হয়েছে, এটা লঘু পাপে গুরুদণ্ড হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে কী? ওই যুবকটির সামাজিক সম্মান কি আর ফেরত পাওয়া যাবে? আবার ধরা যাক উত্তরপ্রদেশের ৩৬ বছর বয়সী, ফিরোজ আহমেদকে ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়, হিন্দু যুব বাহিনীর এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, নরসিংহ পান্ডের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়। বলা হয়, ফিরোজের পাঠানো একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারত, তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল। তারপর তাঁর বিরুদ্ধেও সেই দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়।

দেখা গেছে, ডান, বাম বিভিন্ন সরকার নানান সময়ে এই দেশদ্রোহিতার আইনটিকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করেছেন। আমাদের রাজ্যেও বাম সরকারের আমলে রাজা সরখেল, অভিজ্ঞান সরকার সহ নানান মানুষকে এই অভিযোগে কারাগারে বন্দি করা হয়। কিছুদিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুম্বাইতে বলেন, তাঁর রাজ্যে তাঁর আমলে এই ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু সত্যিটা কি তাই? কিছুদিন আগেই সমাজকর্মী জয়িতা দাসকে নদিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ইউএপিএ আইনে (UAPA Law), যা দেশদ্রোহিতার আইনের চেয়েও ভয়ঙ্কর। টিপু সুলতান, প্রতীক সহ আরও নানান মানুষকে বিনা কারণে গ্রেপ্তার করেছে এই মা-মাটি–মানুষের সরকার। নানান সময়ে বিভিন্ন থানা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন সমাজকর্মীদের হেনস্থা যে করেছে, তার উদাহরণও আছে আমাদের কাছে।

১৯৬২ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে যখন কেদার নাথ সিং বনাম বিহার রাজ্যের মামলা হয়, তখন আদালত রায় দেন, একমাত্র মৌখিকভাবে যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো দুরভিসন্ধিমুলক কাজ করে, যার মধ্যে দিয়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সম্ভাবনা থাকে, তাহলেই একমাত্র ১২৪ এর ক ধারা, অর্থাৎ দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা যাবে। পরে ১৯৯৫ সালে আরও একটি মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত একই রায় বহাল রাখে, কিন্তু সেই রায় কিংবা ১৯৬২ সালের রায়ে কোথাও এটা বলা নেই, যে কে বা কারা নির্ধারণ করবে, কোন বক্তব্য হিংসার উদ্রেক করছে বা করছে না? আসলে অতীতের এই রায়ে শুধু সাধারণ কিছু ভাষাভাষা নিয়মাবলী বলা থাকে, আর তার ফাঁক দিয়ে, পুলিশ বারংবার বিভিন্ন সরকার বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে এই দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে এসেছে। সেইদিক দিয়ে এবারের রায়ে আশার দিক এটাই, যে যতদিন না পর্যন্ত আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ, এই বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দেবে, ততদিন এই আইন কোনও মানুষের ওপর লাগু করা যাবে না, তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।

তাহলে এখন সমাজকর্মী বা মানবাধিকার সংগঠনগুলির কি কাজ? এই রায়, যাতে দেশের ৮০০ জেলার, ১৬৯৫৫টি পুলিশ ফাঁড়িতে পৌঁছয়, তা সবার আগে সুনিশ্চিত করতে হবে। সরকার যদিও হলফনামা জমা দিয়ে বলেছে, যে তাঁরা এই দেশদ্রোহিতার আইন নিয়ে পুর্নবিবেচনা করবে, কিন্তু আদালত তাঁদের কাছে জানতে চায়নি এই প্রক্রিয়া কতদিন ধরে চলবে? সুতরাং তাহলে কি এটা বলা যায়, পরবর্তী শুনানি অবধিই এই রায়ের মেয়াদ? তাহলে কি সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়, সরকারি আধিকারিকেরা কীভাবে সমস্ত থানার কাছে এই বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন, তার ওপরেই নির্ভরশীল হয়ে থাকবে? তাহলে কি উচ্ছাস করার কোনো অবকাশ আছে? আরও একটি বিষয় এখানে বলা জরুরি, এই দেশদ্রোহিতার আইনের পাশাপাশি, সরকারের কাছে অন্যান্য যে আইনগুলো আছে, তা নিয়েও কথা শুরু করতে হবে এখনই। ২০১৯ সালে, কুখ্যাত ইউএপিএ আইনকে এই সরকার যেভাবে আরও শক্তিশালী করেছে, তা নিয়েও আলোচনা করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। শুধু সামাজিক মাধ্যমে নয়, রাস্তায় নেমে মানুষকে বোঝাতে হবে এই সমস্ত আইনগুলো সম্পর্কে। এছাড়াও জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি করার মধ্যে দিয়ে আসলে সেই ঔপনিবেশিক আইনগুলোকেই আরও শক্তিশালী করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তাও মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া জরুরি। বিরোধী সব রাজনৈতিক দলেদের আজকে এই আইনগুলোর প্রত্যেকটির বিরোধিতায় আরও সরব হতে হবে, না হলে প্রাক্তন বিজেপি নেতা অরুণ শৌরি বা সংসদে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়া মহুয়া মৈত্র, যতই আদালতে শুধুমাত্র এই দেশদ্রোহিতার আইন নিয়ে সরব হোক না কেন, আদপে কাজের কাজ কিছু হবে না। ওই আইনে যদি অশীতিপর স্ট্যান স্বামীকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, অন্য আইন দেখিয়ে, উমর খালিদ, গৌতম নওলাখা বা আনন্দ তেলটুমডে বা অন্য যে-কোনো সরকার বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে জেলের মধ্যে রেখে দেওয়া যাবে। আজকের সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ে হয়তো সাময়িক স্বস্তি মিলবে, কিন্তু অন্যান্য আইনগুলোর বিরুদ্ধে যদি আওয়াজ না তোলা যায়, তাহলে নাগরিক সমাজের এই উচ্ছ্বাস অচিরেই আরও বড়ো যন্ত্রণা হিসেবে সামনে আসবে। এটা মনে রাখা জরুরি এই সরকার চায় না, আগামী প্রজন্ম কোনো গণতান্ত্রিক, উদার বামপন্থী শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, আর তাঁরা খুব ভালো করে জানেন, মূলত বামপন্থী মানুষেরাই এই শিক্ষা দিতে পারেন, তাই তাঁদেরকে কিভাবে ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ঘোষণা করতে হয়, সে আইনও তাঁদের হাতের মুঠোয় রাখতে তাঁরা বদ্ধপরিকর হবে, তা নিয়ে কি কোনো সন্দেহ আছে?

(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার ও সমাজকর্মী। মতামত ব্যক্তিগত।)

Powered by Froala Editor