সদ্যপ্রয়াত বাবার ইজিচেয়ারে ছবি বিশ্বাসকে বসতে অনুরোধ করলেন উত্তমকুমার

১৯৬২ সালের ৯ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছিল 'দাদাঠাকুর'। তার পাঁচ মাস আগে গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এই ছবির নাম ভূমিকার অভিনেতা ছবি বিশ্বাস। কিন্তু যাঁর জীবনী নিয়ে এই ছবি সেই দাদাঠাকুর শরৎ পণ্ডিত তখন বহাল তবিয়তে জীবিত। নিজ কর্মগুণে এবং পুরুষকারে একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। এমন না হলে জীবিতাবস্থায় কোনো ব্যক্তির জীবন কাহিনি নিয়ে ছবি তৈরি হতে সচরাচর দেখা যায় না। 

যাইহোক, সেই বাস্তবের দাদাঠাকুর শরৎ পণ্ডিত তখন কোনো কাজে জঙ্গীপুর থেকে কলকাতায় এসেছেন। উঠেছেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের (বর্তমানে রাজা রামমোহন রায় সরণি) একটি মেস বাড়িতে। শিয়ালদহের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল সেখানকার একটা সিনেমা হলের সামনে লোকের ভিড় দেখে। সেই হলে 'দাদাঠাকুর' ছবি দেখার জন্য দর্শকরা ব্যাকুল। স্বয়ং বাস্তবের দাদাঠাকুরের দিকে কারো তাকিয়ে দেখার ফুরসত নেই। ব্যাপার দেখে শরৎ পণ্ডিতকে তাঁর সফরসঙ্গী বললেন, দেখেছেন  আপনি বর্তমান থাকতেও আপনাকে না নিয়ে ছবি বিশ্বাসকে নিয়েছে আপনার রোলে। দাদাঠাকুর বলে উঠলেন, "ছবি দেখে লোকে বিশ্বাস করবে বলেই তো ছবি বিশ্বাসকে নেওয়া।" দাদাঠাকুর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে পানিং করে কথাটা বললেও এই ছোট্ট কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলা ছবির কিংবদন্তি অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের অসামান্য অভিনয় ক্ষমতা এবং জনপ্রিয়তার ইঙ্গিত। 

উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবারে ভূপতিনাথ বিশ্বাস ও কাত্যায়নি দেবীর চার ছেলের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শচীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল ১৯০০ সালের ১৩ জুলাই (মতান্তরে ১২ জুলাই)। ছবির মতো সুন্দর দেখতে ছিলেন বলে তাঁর মা ডাকতেন ছবি নামে। মাত্র দশ মাস বয়সে তাঁর মা চলে গেলেও মায়ের দেওয়া এই নামের মধ্যেই তিনি মা'কে অনুভব করেছেন সারাজীবন। ভূপতিনাথের আদি নিবাস নদীয়া জেলার ছোট জাগুলিয়া গ্রামে। সেখানে প্রাসাদোপম 'কালী নিকেতন' তাঁদের বিখ্যাত বাড়ি। 

ছবি বিশ্বাসের ছাত্রজীবন কেটেছে হিন্দু স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বিদ্যাসাগর কলেজে। প্রথম যৌবনে পাড়ার ক্লাব, কাঁকুড়গাছি নাট্যসমাজ, শিকদার বাগান স্ট্রিটের বান্ধবসমাজ ইত্যাদি জায়গায় নাট্যচর্চা ও শখের যাত্রাপালায় অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু শিক্ষিত পরিবারের ছেলের যাত্রা থিয়েটার নিয়ে বেশি মাতামাতি অভিভাবকদের অপছন্দ। ফলে জীবিকার সন্ধানে ক্রমান্বয়ে বীমা কোম্পানি, বেঙ্গল টেলিফোন কোম্পানিতে চাকরি, পাটের ব্যবসা প্রভৃতি পেশায় কিছুদিন করে যুক্ত থেকেও কোনোটাতেই মন বসাতে পারছিলেন না। এসবের পাশাপাশি অবশ্য  অভিনয় টুকটাক চলছিল। 

ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে অভিনয় করতে গিয়ে কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, নরেশ মিত্র, শিশির ভাদুড়ি প্রমুখ গুণীজনের সান্নিধ্যে আসেন। এইভাবে সেকালের বিখ্যাত চলচ্চিত্র  প্রযোজক প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নজরে পড়ে গেলেন। তিনি ডেকে নিয়ে গিয়ে সুযোগ দিলেন তাঁর 'অন্নপূর্ণার মন্দির' ছবিতে। পরিচালক ছিলেন সেকালের বিখ্যাত অভিনেতা তিনকড়ি চক্রবর্তী। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৬ সালের ১৩ জুন। ছবিটি বাণিজ্যিক সফলতা পায়নি। এর পরে আরো ছ-সাতটি ছবিতে সুযোগ পেলেও সাফল্য সেভাবে ধরা দিল না। এদিকে ততদিনে পূর্বতন জীবিকা থেকেও সরে এসেছেন। ফলে অভিনয় জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। 

আরও পড়ুন
শুধু উত্তমকুমারই নন, অন্যান্য নায়কদের কণ্ঠেও অবিস্মরণীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

অবশেষে সাফল্য ধরা দিল ১৯৪১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে নির্মিত হেমচন্দ্র চন্দ্রের পরিচালনায় 'প্রতিশ্রুতি' ছবিতে। ব্যাস, আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের বছরেই মুক্তি পেয়েছিল তাঁর অভিনীত 'পাষাণ দেবতা', 'অভয়ের বিয়ে', 'গরমিল', 'বন্দী', 'পরিণীতা' প্রভৃতি ১৩টি ছবি। একের পর এক ছবিতে অভিনয়ের অফার আসতে লাগল। তিনিও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর প্রতি পরিচালক ও প্রযোজকদের আস্থার মর্যাদা দিয়ে গেছেন সমগ্র অভিনয়জীবন জুড়ে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালে এক একটি বছরে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ছিল ২১ থেকে ২৭। এমনও সময় গিয়েছে একই সঙ্গে ছ-সাতটি ছবিতে কাজ করেছেন। এক চরিত্র থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের আর এক চরিত্রের জটিলতার ভিতর দ্রুত পায়ে ছোটাছুটি করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু কোনো সময়েই তিনি পথ হারাননি। কারণ তিনি ছবি বিশ্বাস। 

তবে প্রচলিত অর্থে নায়ক বলতে যা বোঝায় ছবি বিশ্বাস কোনোদিনই তা ছিলেন না। তিনি ছিলেন সর্বার্থেই একজন সফল চরিত্রাভিনেতা। তাঁকে ছাড়া সে সময়ে অনেক ছবিই কল্পনা করা যেত না। যদিও নায়কোচিত সৌম্যকান্তি রূপ, আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা এবং অভিনয় ক্ষমতা সবই তাঁর ছিল, কিন্তু চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম অভিনয় ৩৪ বছর বয়সে। তখন তিনি যৌবনের প্রান্তসীমায়। নায়ক সাজার বয়স পেরিয়ে এসেছেন।

আরও পড়ুন
বুকে এসে লাগল গাড়ির স্টিয়ারিং, দেশের বাড়ি যাওয়ার পথেই মারা গেলেন ছবি বিশ্বাস

১৯৫৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর মাইলস্টোন ছবি তপন সিংহ পরিচালিত 'কাবুলিওয়ালা'। এতেও তিনি নামভূমিকায়। রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে উচ্চ প্রশংসিত এই ছবি। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারতে হইচই পড়ে গিয়েছিল। কলকাতার বাইরেও বম্বে, দিল্লি, মাদ্রাজ, পুনে প্রভৃতি জায়গায় 'কাবুলিওয়ালা'র জয়জয়কার। একটি সাক্ষাৎকারে তপন সিংহ বলেছিলেন, "কাবুলিওয়ালা'র প্রতিটি ফ্রেমে অসাধারণ হয়ে ধরা দিয়েছেন ছবি বিশ্বাস। তবুও তার মধ্যে ছবিদার ডবল প্লে করার মুহূর্তটি অনবদ্য, যেখানে কাবুলিওয়ালা মিনিকে প্রথম দেখছে। আর দেখতে দেখতেই সুদূর আফগানিস্তানে তার নিজের মেয়ের কথা ভাবছে। একই দৃশ্যে দুটো দৃশ্য। প্যারালাল শটে বর্তমানকে ধরে অতীতে ফিরে যাওয়ার ওই রূপকল্পনায় ছবিদার অভিনয় অবিস্মরণীয়। ...আমার তো মনে হয় 'কাবুলিওয়ালা' আমার ছবি নয়, ছবি বিশ্বাসের ছবি।" 

উল্লেখযোগ্য আরো বহু ছবি তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয়গুণে সমৃদ্ধ হয়ে আছে – ‘সমাধান’, ‘পথ বেঁধে দিল’, 'দুই পুরুষ', 'সাত নম্বর বাড়ি', 'চন্দ্রশেখর', 'রাত্রির তপস্যা', 'ওরা থাকে ওধারে', 'ঢুলি', 'সদানন্দের মেলা', 'সবার উপরে', 'সাগরিকা', 'শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক', 'ত্রিযামা', 'একদিন রাত্রে', 'বড়দি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'পৃথিবী আমারে চায়', 'পথে হল দেরি', 'শশীবাবুর সংসার', 'সপ্তপদী', 'হেডমাস্টার', 'জলসাঘর', 'দেবী', 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' এরকম অসংখ্য ছবির কথা বলা যায়। মাত্র ২৬ বছরের অভিনয় জীবনে ২৫৬টি বাংলা ও তিন-চারটি হিন্দি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন। 

আরও পড়ুন
উত্তমকুমারের ৭২টি সিনেমার ক্যামেরাম্যান ছিলেন তিনি, দারিদ্র্য থেকে চিরমুক্তি বৈদ্যনাথ বসাকের

বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার আর একটি মাইলফলক 'জলসাঘর'। পরিচালক সত্যজিৎ রায় এই ছবি প্রসঙ্গে বলেছেন, "ছবিবাবুর মতো অভিনেতা না থাকলে 'জলসাঘর'-এর মতো কাহিনির চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হত কিনা জানিনা। বোধহয় না। একদিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃশ্যকারিতা, অন্যদিকে তাঁর পুত্রবাৎসল্য ও সংগীতপ্রিয়তা এবং সবশেষে তাঁর পতনের ট্রাজেডি – একাধারে সবগুলির অভিব্যক্তি একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।" 

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি পেশাদার মঞ্চেও ছবি বিশ্বাসের ছিল অনায়াস বিচরণ। ‘মীরকাশিম’, ‘ধাত্রীপান্না’, ‘দুই পুরুষ’, ‘বিজয়া’, ‘পথের দাবি’, ‘সাজাহান’, ‘প্রফুল্ল’, ‘ডাকবাংলো’ প্রভৃতি নাটক তাঁর অসাধারণ অভিনয়গুণে সমৃদ্ধ। মনোজ বসুর 'বৃষ্টি' উপন্যাসের নাট্যরূপ 'ডাকবাংলো' স্টার থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৫৯ সালের ১২ মার্চ। প্রধান চরিত্র বিশ্বেশ্বরের ভূমিকায় ছবি বিশ্বাসের অভিনয় তখন সাড়া ফেলে দিয়েছিল। টানা ২৩৮ রজনী চলেছিল এই নাটকটি। অথচ এর আগে প্রায় ৯ বছর তিনি মঞ্চাভিনয় থেকে সরেছিলেন হাঁপানির জন্য। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে তিনি শেষবারের মতো মঞ্চে অভিনয় করেন 'শ্রেয়সী' নাটকে স্টার থিয়েটারে। 

বাংলা ছবির ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারকে ছবি বিশ্বাস পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। বহু ছবিতে দু'জনে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। শ্যুটিংয়ের সময় কোনো শট ছবি বিশ্বাসের মনোমতো না হলে উনি যতবার রিটেক করতে বলতেন, তাঁর পরামর্শকে সম্মান দিয়ে উত্তমকুমার একবাক্যে তা মেনে নিতেন। উত্তমবাবুর পিতৃবিয়োগের পর তাঁর গুরুদশায় ছবিবাবু প্রতিদিন সকালে উত্তমকুমারের বাড়িতে যেতেন। উত্তমবাবুর বাবা যে ইজিচেয়ারে বসতেন, সেটিতেই ছবিবাবুকে বসতে অনুরোধ করতেন উত্তম। 

ছবি বিশ্বাস ছিলেন মনেপ্রাণে শিল্পী। অবসর পেলেই ছবি আঁকতেন। মাটির ফুলদানি, মাটি এবং প্লাস্টিকের পাত্র ও প্লেটের উপর ছবি এঁকে রং করতেন। এছাড়া বুটিকের কাজ, এমব্রয়ডারির কাজেও পারদর্শী ছিলেন। বাগান করার শখ ছিল। তাঁর বাঁশদ্রোনির বাড়িতে নিজের হাতে তৈরি নানারকম ফুল এবং সবজির বাগান ছিল দেখার মতো। 

শিল্পী এবং কলাকুশলীদের আর্থিক এবং অন্যান্য সমস্যায় সর্বদাই তাঁদের পাশে থেকেছেন। এই উদ্দেশ্যে 'অভিনেতৃ সঙ্ঘ' গড়ার পিছনেও ছবি বিশ্বাসের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৫৭ সালে 'কাবুলিওয়ালা' ছবির জন্য তাঁর রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্তি এবং বার্লিনে আন্তর্জাতিক সম্মানলাভের কথা আগেই বলেছি। এর আগে ১৯৪৩ সালে 'দিকশূল' ছবিতে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পেয়েছেন বি.এফ.জে.এ. পুরস্কার। ১৯৫৯ সালে তিনি সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। 

১৯৬২ সালের ১১ জুন ছোট জাগুলিয়ায় পৈতৃক বাড়িতে যাওয়ার পথে মধ্যমগ্রামের কাছে গঙ্গানগরে যশোর রোডে ছবি বিশ্বাসের গাড়িকে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মালবোঝাই লরি ধাক্কা মারলে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে তিনি নিজেই চালাচ্ছিলেন গাড়িটা। স্টিয়ারিংয়ের ধাক্কায় তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙে যায়। আর জি কর হাসপাতালে আনা হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নির্দেশে পোস্টমর্টেম করা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল তাঁর মরদেহ। এই ঘটনায় সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, "তাঁর অকালমৃত্যুজনিত ক্ষতি আমার কাছে অপরিমেয়, অপূরণীয়। তাঁর উপযুক্ত আরও অনেক চরিত্র, অনেক কাহিনি আমার পরিকল্পনায় ছিল। এ সবই তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার মন থেকে মুছে ফেলে দিতে হয়েছে।" 

শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ছবি বিশ্বাসের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

আলোকচিত্র: কল্যাণী মণ্ডল সম্পাদিত ‘নও শুধু ছবি’ (নীরাজনা প্রকাশনা) গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।

Powered by Froala Editor