শেরপাদের ভবিষ্যৎ নেই নেপালে, ক্ষুব্ধ ২৮ বার এভারেস্টজয়ী

কয়েক মাস আগের কথা। ২৮তম বার এভারেস্টের শিখরে পৌঁছে এক অনন্য নজির গড়েছিলেন তিনি। তৈরি করেছিলেন এক নতুন ইতিহাস, বিশ্বরেকর্ড। কামি রিতা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘রয়টার্স’-এর এক সাক্ষাৎকারে এবার চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আনলেন নেপালের এই শেরপা। এমনকি তাঁর কথায়, নেপালে কোনো ভবিষ্যৎ-ই নেই শেরপাদের (Sherpas)। 

৫৩ বছর বয়সি কামি রিতা (Kami Rita) বর্তমানে নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুর বাসিন্দা। অবশ্য তাঁর জন্ম হয়েছিল নেপালের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম সোলুখুম্বুতে। উল্লেখ্য, এই গ্রামেই জন্ম আরও এক কিংবদন্তি পর্বতারোহী তেনজিং নোরগের। এডমন্ড হিলারির পথপ্রদর্শক হিসাবে যিনি বিশ্বের প্রথম মানুষ হিসাবে পা রেখেছিলেন এভারেস্ট চূড়ায়। সোলুখুম্বু মূলত শেরপাদের গ্রাম। যুগ যুগ ধরে এই গ্রামের মানুষ সঙ্গ দিয়ে আসছে পর্বতারোহীদের। এভারেস্ট তো বটেই, মাউন্ট লোৎসে, মাকালু, নুপৎসে— নেপালের প্রায় সমস্ত আট হাজারি পর্বতশৃঙ্গের বেসক্যাম্পে হাজির হলেই দেখা মিলবে সোলুখুম্বুর কোনো-না-কোনো শেরপার সঙ্গে। 

কামি রিতার ব্যাপারটাও ছিল অনেকটা এরকমই। কৈশোরে গ্রামের স্কুলেই পড়াশোনা। তারপর কাঠমাণ্ডুতে কয়েকদিনের ট্রেনিং-এর পর জুটিয়েছিলেন পর্বতারোহণের একটি শংসাপত্র। সেই শুরু। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পর্বতারোহীদের পথপ্রদর্শকের পেশাকেই তারপর বেছে নেন তিনি। তবে সোলুখুম্বুর এই চেনা দৃশ্যই ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে দিনে দিনে। বলতে গেলে ফাঁকা হয়ে গেছে গ্রামের অর্ধেকাংশ।

কামি রিতার কথায়, নেপালের মূল শহরগুলিতে উন্নয়ন হলেও, আজও কোনো বিশেষ পরিকাঠামো তৈরি হয়নি প্রান্তিক অঞ্চলে। নেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, ভালো চিকিৎসা পরিষেবাও। ফলে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন শেরপারা। কামি রিতা নিজেও গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন দেশের রাজধানীতে। পেশাগত দিক থেকে সফল হওয়ার জন্য এবং ঝুলিতে একাধিক রেকর্ড থাকার ফলে, দিনযাপনে ততটাও অসুবিধা হচ্ছে না তাঁর। কিন্তু যে-সকল শেরপারা ততটাও প্রতিষ্ঠিত নন, তাঁরা?

নেপালের মোট জিডিপি বা আয়ের ১০ শতাংশের নেপথ্যে রয়েছে কেবলমাত্র পর্বতারোহণ। এভারেস্ট ও অন্যান্য শৃঙ্গ অভিযান করতে প্রতি বছরই নেপালে ভিড় জমান বিদেশি পর্যটকরা। শুধুমাত্র তাঁদের ছাড়পত্র বা পারমিট প্রদানের মাধ্যমেই ৫৮ লক্ষ মার্কিন ডলার আয় করে নেপাল সরকার। তাছাড়াও এই পর্যটকরা বড়ো ভূমিকা রাখেন দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহ বজায় রাখতে। মজার বিষয় হল, শেরপাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে মুছে গেলে, ভেঙে পড়বে এই গোটা অর্থনৈতিক সমীকরণটাই। অথচ, তা সত্ত্বেও শেরপাদের জন্য ন্যূনতম কোনো সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে না নেপাল প্রশাসন। 

অভিযানের আগে শেরপাদের পরিবারের জন্য ১১ হাজার মার্কিন ডলারের বিমার ব্যবস্থা করতে হয় অভিযাত্রীদের। তবে কামি রিতার কথায় তা সামান্য। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য এই অর্থের পরিমাণ প্রায় তিন গুণ করা উচিত বলেই অভিমত তাঁর। পাশাপাশি শেরপাদের বেতনবৃদ্ধির জন্য আলাদাভাবে উদ্যোগ নেওয়া উচিত প্রশাসনের। শুরু করা উচিত পৃথক প্রকল্প। কেবলমাত্র গতমাসেই তুষারধ্বসে মৃত্যু হয়েছে ৩ শেরপার। অথচ, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য বা ক্ষতিপূরণ পৌঁছায়নি তাঁদের পরিবারের কাছে। এমন চলতে থাকলে, আগামী প্রজন্ম সম্পূর্ণভাবে সরে যাবে এই পেশা থেকে। 

বর্তমানে তেমনটাই হচ্ছে। নেপালের শেরপা সম্প্রদায়ের তরুণরা ক্রমশ ঝুঁকছেন অন্যান্য পেশায়। কামি রিতার নিজের সন্তানরাও পর্বতারোহণ ছেড়ে প্রযুক্তিবিদ্যাকে বেছে নিয়েছেন পড়াশোনার বিষয় এবং কেরিয়ার হিসাবে। এমনকি সপরিবারে মার্কিন মুলুকে গিয়ে বসতি স্থাপনের কথাও ভাবছেন বিশ্বরেকর্ড তৈরি করা শেরপা। আজ থেকে ৭০ বছর আগে উপার্জনের আশায় নেপাল ছেড়ে ভারতে চলে এসেছিলেন তেনজিং। সেই ধারা বজায় রয়েছে আজও। আজও শেরপাদের প্রতি এতটুকু সদয় হয়নি নেপাল প্রশাসন। যার ফলস্বরূপই হয়তো কামির মতো বহু শেরপা বাধ্য হচ্ছেন দেশ ছাড়তে।

Powered by Froala Editor