অহেতুক সর্পহত্যা নয়, সাপেদের 'ত্রাতা' হয়ে উঠছেন ১৮ বছরের কিশোর

আজ থেকে প্রায় ৬ বছর আগের কথা। তখন ১২ বছর বয়স তাঁর। কোনোরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই প্রথমবার বিষধর সাপ ধরেছিলেন তিনি। তবে প্রাণে মারেননি তাকে। বরং, ছেড়ে দিয়ে এসেছিলেন জলাশয়ের ধারে। হরিওম চৌবে। এখনও কৈশোরের গণ্ডি পেরোননি ১৮ বছর বয়সি বক্সারের বাসিন্দা। তা সত্ত্বেও বিহারের অন্যতম ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউয়ার হয়ে উঠেছেন তিনি। পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন প্রাণীকল্যাণকেই।

বক্সারের প্রান্তিক গ্রামেই বেড়ে ওঠা হরিওম-এর। ফলে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তিনি দেখে আসছেন মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর সংঘাত। প্রতিবছর বর্ষার সময় ডুবে যায় মাঠ, রাস্তাঘাট। জল ঢুকে পড়ে বাড়ির উঠোনেও। আর তার সঙ্গেই এক ধাক্কায় বৃদ্ধি পায় সাপের উপদ্রব। বাধ্য হয়েই তাদের মেরে ফেলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অন্যদিনে পরিসংখ্যান বলছে সাপের কামড়ে নাকি বিহারে ৩০০-র বেশি মানুষ মারা যান প্রতিবছর। এই ঘটনাই ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল হরিওমকে। উন্নয়নের জন্য বাসস্থান হারাচ্ছে সাপেরা, সংঘাত বাড়ছে মানুষের সঙ্গে, সে-কথা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তাঁর। কিন্তু উন্নয়ন কিংবা সভ্যতার প্রসারণ তো থামিয়ে রাখাও যায় না। তবে উপায়?

হ্যাঁ, নিজেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে ওঠেন হরিওম। গ্রামে কারোর বাড়ি সাপ ঢোকার খবর পেলেই তা বাঁচাতে ছুটতেন তিনি। তারপর সযত্নে তাদের ছেড়ে দিয়ে আসতেন অরণ্য কিংবা জলাভূমিতে। আর সাপ ধরার ট্রেনিং? না, প্রথাগত প্রশিক্ষণ নেই তাঁর। এসবই তাঁর শেখা বই পড়ে। সাপের প্রজাতি, চরিত্রের ব্যাপারেও হরিওম জেনেছেন বিভিন্ন বই-এর সূত্র ধরেই। 

২০১৯ সাল থেকেই সাপ উদ্ধারকারীর ভূমিকাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন হরিওম। তবে তাঁর জীবনকে বদলে দিয়েছিল ২০২১ সালের একটি ঘটনা। একটি তথ্যচিত্রের জন্য সেবার তিনি ডাক পান ‘ডিসকভারি’ চ্যানেলের। বাংলার শিলিগুড়িতে শ্যুটিং হয়েছিল সেই তথ্যচিত্রের। বাংলায় এসে প্রথমবারের জন্য বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়কেন্দ্র বা রেসকিউ সেন্টার চাক্ষুষ করেন তিনি। শ্যুটিং-এর ফাঁকেই প্রশিক্ষণ নেন কীভাবে বন্যপ্রাণীদের উদ্ধার করে চিকিৎসা করা হয় তাদের, তারপর ফের ফিরিয়ে দেওয়া হয় প্রকৃতির বুকে। 

বিহারে ফিরে প্রথমে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অনুরূপ আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির আবেদন জানান তিনি। তবে তাতে কোনো ফলাফল না হওয়ায়, নিজের পৈতৃক জমিতেই খুলে ফেলেন আস্ত একটি রেসকিউ সেন্টার। চূড়ামনপুর অবস্থিত ১০ কাঠা জমিতে বিস্তৃত এই আশ্রয়কেন্দ্রই এখন বেশ কিছু আহত ও অসুস্থ কুকুর, বেড়াল, বেঁজি, গরু এমনকি বিরল প্রজাতির প্যাঁচার বাসস্থান। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্যপ্রাণীরা সুস্থ হয়ে উঠলে তাদের ছেড়ে দেন হরিওম। আর এই আশ্রয়কেন্দ্র চালানোর খরচ? সেটা জোটে সাপ উদ্ধার করে। প্রতি সাপ উদ্ধার পিছু ১০০ টাকা পারিশ্রমিক নেন তিনি। শুনলে অবাক হতে হয়, এই আশ্চর্য পেশায় বিগত সাত মাসে ৭০ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছেন হরিওম। 

তবে গ্রামবাসীদের একাংশ খুব একটা ভালো চোখে দেখে না তাঁর এই কর্মকাণ্ডকে। বহু মানুষের বিশ্বাস, তাঁর এই কর্মকাণ্ডই অভিশাপ ডেকে আনছে গ্রামে। মাস কয়েক আগে অজ্ঞাত পরিচয় কোনো ব্যক্তি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর আশ্রয়কেন্দ্রে। ভাগ্যবশত ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি কোনো বন্যপ্রাণী। বর্তমানে এই আশ্রয়কেন্দ্রকে ধীরে ধীরে ফের গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন বিহারের কিশোর। সেইসঙ্গে লক্ষ্য, সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা গড়ে তোলা। তা নাহলে বদলাবে না পরিস্থিতি, এমনটাই মনে করেন ১৮ বছর বয়সি কিশোর…

Powered by Froala Editor

Latest News See More