১ নভেম্বর, বাংলাকে ঘিরে পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল পুরুলিয়ার

বাংলা ভাষার জয়গান আজ বিশ্বজুড়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রক্তাক্ত রাস্তা সে পরিচিতি এনে দিয়েছে। বরকত, জব্বার, সালামদের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিও। কিন্তু এর পাশাপাশি, মাতৃভাষার জন্য মানভূমের বাঙালিদের দীর্ঘ আন্দোলন নিয়ে যে কোনও রকম আলোচনা থেকে বিরত থাকেন অনেক বাঙালি। অবহেলা না আত্মবিস্মরণ? ভুলে গেলে চলবে না, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতগুলো ভাষা আন্দোলন হয়েছে, তার মধ্যে দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলনও এই বাংলার মাটিতেই। না, সেটি ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন নয়। তা হল মানভূমের ভাষা আন্দোলন।

আরও পড়ুন
'হাতির মতো বড় উৎসব' সহরায়ের সঙ্গে মিশে সাঁওতালদের ভিটে বাঁচানোর যুদ্ধের ইতিহাস

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে, ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের নীতির বাস্তব রূপায়নের দাবিতে দেশের আঞ্চলিকতা বেড়ে উঠতে শুরু করে। সেই পরিস্থিতিতে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দেশের ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন নিয়োগ করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কমিশন মত দেয় যে, শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন না করে ভারতের ঐক্যবদ্ধতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই, তৎকালীন বিহার সরকার ওই রাজ্যের মানুষদের ওপর হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রাথমিক স্তরে ও সরকারি অনুদান যুক্ত বিদ্যালয়ে হিন্দি মাধ্যমে পড়ানোর নির্দেশ আসে, জেলা স্কুলগুলিতে বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে শুধুমাত্র হিন্দিতে শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাঙালির মানভূমে তখন থেকেই শুরু হল এক রকম ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’। একের পরে এক বাংলা স্কুল পরিণত হল হিন্দি স্কুলে। পোস্ট অফিস-সহ সমস্ত সরকারি দফতরে হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হল। এর বিরুদ্ধেই মানভূমের ভাষা আন্দোলন। গর্জে ওঠে লক্ষ লক্ষ বাঙালি। শিক্ষা ও প্রশাসনিক স্তরে তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে স্বীকৃতির জন্য শুরু হয় আন্দোলন।

বিহার রাজ্য সরকার মানভূমে বাংলার ব্যবহার সীমিত করার জন্য কঠোর হতে শুরু করলে অতুলচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত সহ ৩৭ জন নেতা কংগ্রেসের জেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করে ‘লোক সেবক সংঘ’ গঠন করেন। এই সংঘ বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে।

কিন্তু ১৯৪৬-এর বিহার নিরাপত্তা আইনের ‘নামে’ অত্যাচার শুরু হল ভাষা আন্দোলনকারীদের উপরে। সত্যাগ্রহকে দমন করার জন্য হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বিচিত্র দমন-পীড়ন। শুরু হল ‘টুসু সত্যাগ্রহ’। মানভূমের লোকগান ‘টুসু’, সাধারণের স্বতোৎসারিত আবেগ মিশে থাকে। তাতেও ফুটে উঠতে লাগল বাংলা ভাষার প্রতি আবেগ। ১৯৫২ সালে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হলেন ‘লোকসেবক সংঘে’র দুই জন প্রার্থী (ভজহরি মাহাতো ও চৈতন মাঝি)। বিধানসভায় জিতে এলেন সাতজন। মানভূমে বাংলা ভাষার আন্দোলন দৃষ্টি আকর্ষণ করল কলকাতা ও দিল্লির।

সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হল -

শুন বিহারী ভাই, তোরা রাখতে লারবি ডাঙ্ দেখাই
তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি, বাংলা ভাষায় দিলি ছাই
ভাইকে ভুলে করলি বড় বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই
বাঙালী-বিহারী সবই এক ভারতের আপন ভাই
বাঙালীকে মারলি তবু বিষ ছড়ালি — হিন্দি চাই
বাংলা ভাষার পদবীতে ভাই কোন ভেদের কথা নাই
এক ভারতের ভাইয়ে ভাইয়ে মাতৃভাষার রাজ্য চাই
(গীতিকার - ভজহরি মাহাতো)

মানভূম ভাষা আন্দোলনে নারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল অপ্রতিরোধ্য। জননেত্রী লাবণ্যপ্রভা দেবীকে পুলিশ ও রাজনৈতিক গুন্ডারা চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বের করে, সঙ্গে চলে অকথ্য নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানি। শবরনেত্রী রেবতী ভট্টাচার্যকে পিটিয়ে জঙ্গলের মধ্যে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায় বিহারি পুলিশ। জননেত্রী ভাবিনী মাহাতোর ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। এই সময় বিহারের জননিরাপত্তা আইনের ধারায় লোকসেবক সংঘের কর্ণধার অতুলচন্দ্র ঘোষ, লোকসভা সদস্য ভজহরি মাহাতো, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, অশোক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়।

এরই মধ্যে শুরু হয় সীমা কমিশনের কাজ। সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের তৎকালীন দুই মুখ্যমন্ত্রীর (বিধানচন্দ্র রায় ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহ) তরফে বঙ্গ-বিহার যুক্ত প্রদেশ গঠন করার প্রস্তাব আসে। ইতিমধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করে ‘টুসু সত্যাগ্রহ’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

মানভূমের ভাগ্যের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায়, ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে লোক সেবক সংঘের আন্দোলনকারীরা কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। ২০শে এপ্রিল অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে সাড়ে তিনশ’ নারীসহ হাজার দেড়েক আন্দোলনকারী দশটি বাহিনীতে ভাগ হয়ে পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে পদযাত্রা শুরু করেন। ষোলো দিন পর, ৬ই মে কলকাতায় উপস্থিত হয় সেই পদযাত্রা। ২০ এপ্রিল থেকে ৬ মে টানা প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন সত্যাগ্রহীরা। কণ্ঠে ছিল ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে’ গান।

কলকাতাবাসীদের পক্ষ থেকে হেমন্তকুমার, জ্যোতি বসু, মোহিত মৈত্র, সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট নাগরিকগণ সহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ উপস্থিত হয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। সমাবেশ যেন না হতে পারে। এজন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার আগে থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছিল। ফলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে পুলিশ ৯৬৫ জন আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করে। বন্দিদের পাঠানো হয় কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেল, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ও আলিপুর স্পেশাল জেলে। বারো দিন পর তাঁরা মুক্তি পান। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থানে প্রায় ৩,৩০০ আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয়, যারা প্রধানত লোক সেবক সংঘ অথবা বাম দলগুলোর কর্মী ছিলেন।

বাধ্য হয়ে রদ করা হয় বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব। বঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর আইন পাশ হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগষ্ট লোকসভায় ও ২৮শে আগষ্ট রাজ্যসভায় বাংলা-বিহার সীমান্ত নির্দেশ বিল পাশ হয়। ১লা সেপ্টেম্বর এতে ভারতের রাষ্ট্রপতি সই করেন।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের চাপ তখন বাড়ছে ক্রমাগত। ১৯৫৬ সালে মানভূমকে তিন টুকরো করে, বাংলা অধ্যুষিত ১৬টি থানা অঞ্চল জুড়ে জন্ম নিল পুরুলিয়া জেলা। অন্তর্ভুক্ত হল পশ্চিমবঙ্গের।

সীমা কমিশনের রিপোর্ট লোকসভা হয়ে ‘সিলেক্ট কমিটি’ ও আরও নানা স্তর পেরিয়ে ১ নভেম্বর, ১৯৫৬ ২৪০৭ বর্গ মাইল এলাকার ১১,৬৯,০৯৭ জন মানুষকে নিয়ে জন্ম নেয় আজকের পুরুলিয়া। সম্পূর্ণ ধানবাদ মহকুমা বিহার রাজ্যে রয়ে যায়। টুসু সাধিকাদের সেই ভাষা আন্দোলন আজ জনমানসে বিস্মৃতপ্রায় হলেও ইতিহাসের দলিলে তা উজ্জ্বল। মানভূমের এই ভাষা আন্দোলন কোনো স্বাধীন দেশ গড়ার আন্দোলন ছিল না, ছিল কেবল বাংলা ভাষাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার লড়াই। আজকের প্রশাসনিক পুরুলিয়া সেই লড়াইয়েরই ফসল।