বিশ্বের কিছু দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ, যাদের জন্য হয়নি কোনো রক্তপাত

“ও রে হাল্লা রাজার সেনা/ তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল…”

সত্যজিতের কালজয়ী এই গানটার সঙ্গে কে না পরিচিত? ধ্বংসতেই পরিণতি পায় যুদ্ধ, এ-কথা সকলেরই জানা। কিন্তু যুগে যুগে রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করতে যুদ্ধকেই হাতিয়ার করে নিয়েছেন রাষ্ট্রনেতারা। ফলে, অবধারিত রক্তক্ষয়। তবে ঠিক উল্টো ঘটনার নিদর্শনও রয়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে। দ্বন্দ্বের পর, হিংসার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক শক্তিদের জুটি বাঁধতে দেখা গেছে বন্ধুত্বের সুতোয়। আর যুদ্ধ? যুদ্ধ (War) ঘোষণা করে সে-কথাই ভুলে গেছেন স্বয়ং ঘোষক (Declarer)। তবে খাতায় কলমে যুদ্ধ চলেছে কয়েকশো বছর। ফিরে দেখা যাক ইতিহাসের এমনই কিছু অধ্যায়ের দিকে।

নেদারল্যান্ড বনাম সিলি (৩৩৬ বছর)—
১৬৫১ সাল। ডাচ প্রজাতন্ত্র তথা অধুনা নেদারল্যান্ডস যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল সিলি দ্বীপপুঞ্জের বিরুদ্ধে। বর্তমানে যা যুক্তরাজ্যের অংশ। যাই হোক, তখন ইংল্যান্ডজুড়ে চলছে গৃহযুদ্ধ। ডাচদের যুদ্ধ প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই যবনিকা পতন হয় ব্রিটিশ গৃহযুদ্ধের। আর সিলি ঢুকে পড়ে গ্রেট ব্রিটিনের মানচিত্রের ভেতর। সিলি স্বাধীন দেশের সত্তা হারানোর ফলে ভেস্তে যায় ডাচদের যুদ্ধ মহড়া। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ব্রিটিশদের দৌলতে। তবে কোনো শান্তিচুক্তিই স্বাক্ষরিত হয়নি দুই রাষ্ট্রের মধ্যে। ১৯৮৬ সালে একটি প্রশাসনিক নথি থেকে জানা যায়, আনুষ্ঠানিকভাবে ৩৩৬ বছর ধরে চলছে যুদ্ধ। ‘সিলি’ বিষয়টি নজরে আসার পর ‘শত্রুতা’-র অবসান ঘটিয়ে লিখিত শান্তিচুক্ত প্রকাশ করে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস— দুই রাষ্ট্রই।

স্পেন বনাম ডেনমার্ক (১৭২ বছর)—
১৮০৯ সালের ১১ নভেম্বর। স্প্যানিশ শহর হুয়েস্কার ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইউরোপে তখন নেপলিয়নিক যুদ্ধ মধ্যগগনে। আর ডেনমার্ক ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ। ডেনমার্কের সঙ্গে লড়াইয়ের সামর্থ্য না থাকায়, ফ্রান্সের দ্বারস্থ হয় হুয়েস্কার। না, সমর্থন পেতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি স্প্যানিশ শহরটির। ধারে ভারে ফ্রান্স এগিয়ে থাকায়, হুয়েস্কার আক্রমণ থেকে বিরত থেকে যায় ডেনমার্ক। ১৯৮১ সালে এক যুদ্ধ গবেষক প্রথম আবিষ্কার করেন এই যুদ্ধের কথা। কিন্তু অনেক অনুসন্ধানের পরেও খুঁজে পাওয় যায়নি কোনো শান্তিচুক্তি। শেষ পর্যন্ত ১৯৮১ সালে স্পেন ও ডেনমার্কের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। 

আরও পড়ুন
যুদ্ধের মধ্যেই মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বের গল্প বুনছে ইউক্রেনের সারমেয় র‍্যাম্বো

মন্টিনেগ্রো বনাম জাপান (১০২ বছর)—
১৯০৪ সালে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রাশিয়া। তৎকালীন সময়ে মন্টিনেগ্রো ছিল রাশিয়ার অন্যতম মিত্র। ফলে, জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামিল হতে হয় তাদেরও। সেইমতো সৈন্য সাজিয়ে ফেলে মন্টিনেগ্রো। কিন্তু তৎকালীন সময়ে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটির কোনো নৌবহর না থাকায় যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছাতে পারেনি মন্টিনেগ্রোর সেনারা। ১৯০৫ সালে পোর্টসমাউথ শান্তিচুক্তির মাধ্যমে রুশ-জাপানি যুদ্ধের অবসান হয়। তবে মন্টিনেগ্রোর কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন রাশিয়ার জার। এর পর যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে সংযুক্তকরণে স্বাধীন রাষ্ট্রের তকমাও হারায় মন্টিনেগ্রো। ২০০৬ সালে পুনরায় স্বতন্ত্র শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশের করার সময়, মন্টিনেগ্রোর প্রাচীন নথি থেকে পুনরাবিষ্কৃত যুদ্ধের কথা। ১০২ বছর রক্তহীন ‘যুদ্ধ চলা’-র মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপিত হয় জাপান ও মন্টিনেগ্রোর মধ্যে। 

আরও পড়ুন
যুদ্ধ নয়, যুদ্ধের অভ্যেস...

অ্যান্ডোরা বনাম জার্মানি (৪৪ বছর)—
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই জার্মান সাম্রাজ্য যেসকল দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম অ্যান্ডোরা। অ্যান্ডোরার কোনো স্থায়ী সেনাবাহিনী না থাকায় জার্মান আগ্রাসনকে মাথা পেতে নেয় রাজ্যটি। অবশ্য তিনজন স্বেচ্ছাসেবককে জার্মানিতে প্রেরণ করেছিল তারা। খাতায়-কলমে জার্মানি দখল নিয়েছিল অ্যান্ডোরার। পরবর্তীতে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় অ্যান্ডোরাকে আহ্বান জানানো হয়নি। ফলে, আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে বছর পর বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান শাসকদের ট্রায়াল চলার সময় সামনে আসে বিষয়টি। ১৯৫৮ সালে অ্যান্ডোরা ও জার্মানি লিখিতভাবে শান্তিচুক্তিতে প্রবেশ করে।

আরও পড়ুন
যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে এখনও খোলা ‘ক্যাট ক্যাফে’, দায়িত্বে অনড় ইউক্রেনিয়ান নাগরিক


কোস্টারিকা বনাম জার্মানি (২৭ বছর)—
এই যুদ্ধও অনেকটা অ্যান্ডোরার মতোই। ১৯১৮ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ লগ্নে। ক্রমশ গুটিয়ে আসছে জার্মান বাহিনী। সেই সময় জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কোস্টারিকা। ফেডেরিকো টিনোকো তখন কোস্টারিকার রাষ্ট্রপ্রধান। তবে তাঁর সরকারের বৈধতা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন ওঠায়, ভার্সাই চুক্তির বাইরে রাখা হয় কোস্টারিকাকে। ফলে, অন্যান্য রাষ্ট্রদের সঙ্গে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও, কোস্টারিকার সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা চলতেই থাকে জার্মানির। যদিও আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ কিংবা রক্তপাত কোনোটাই হয়নি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর, পটসডাম চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় কোস্টারিকাকে। শর্তাবলি মেনে নেয় দেশটির তৎকালীন প্রশাসন। ২৭ বছর পর ইতি পড়ে যুদ্ধের রীতিতে। 

Powered by Froala Editor