লকডাউনকে হাতিয়ার করেই, ইবোলার মহামারী থামিয়েছিল দরিদ্র আফ্রিকা

এই মুহূর্তে গোটা বিশ্ব সাক্ষী থাকছে ভয়াবহতার। কোনো যুদ্ধ নয়, বন্দুক-মিসাইল নয়; এই ভয় করোনার। এই ভয় মৃত্যুর। যে ভাইরাস গোটা পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে। তাও থামানো যাচ্ছে না করোনাকে। ১৫ লাখের ওপর মানুষ আক্রান্ত। মৃতের সংখ্যা ৯০ হাজার পেরিয়েছে। এরই মধ্যে সময়ের ডায়ালটা যদি একটু পেছনে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে এরকম আরও রোগের নাম পাওয়া যাবে। একটি নাম আমাদের কাছে পরিচিত – ইবোলা। কয়েক বছর আগে যা গোটা পৃথিবীকে এভাবেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

এখানে অবশ্য একটু পার্থক্য আছে। সেটা দিয়েই শুরু করা ভালো। করোনার থেকে বহুগুণ বেশি মারণ ক্ষমতা রাখে ইবোলা। কিন্তু তার বিস্তার খুব বেশি দূর হয়নি। কিন্তু যেখানে যেখানে গেছে, সবাইকে থামিয়ে দিয়েছে। এবার করোনায় আফ্রিকার পরিসংখ্যান অনেকের চমকপ্রদ লেগেছে। এখানকার অনেক দেশই অত্যন্ত দরিদ্র, অবস্থা খুব ভালো না। তা সত্ত্বেও আক্রান্তের সংখ্যাটা ১২ হাজার ছুঁইছুঁই করছে। হ্যাঁ, গোটা মহাদেশের হিসেব এটা। মারা গেছেন প্রায় ৫৭৬ জন। ফেব্রুয়ারিতে প্রথম সংক্রমণ ঘটে এখানে। অথচ এই আফ্রিকাই ২০১৪ সালে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। কারণ, ইবোলা! মূলত পশ্চিম আফ্রিকায় ছড়ালেও, পরে ত্রাস সৃষ্টি করে সমস্ত জায়গায়।

১৯৭৬ সালে প্রথম ইবোলার সংক্রমণের খবর সামনে আসে। সেটাও এই আফ্রিকাতেই; এখনকার দক্ষিণ সুদান আর কঙ্গোতে এটি প্রথম দেখা যায়। মূলত বাদুড়ের শরীর থেকে এই রোগ ছড়ায়। আক্রান্ত বাদুড়ের খাওয়া ফল খেলে, বা সংস্পর্শে এলে এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে। তারপর রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দেহজ যেকোনো প্রকারের তরল থেকে অন্যত্র ছড়ায়। একবার রোগাক্রান্ত হলে তাঁকে বাঁচানো প্রায় মুশকিল। এই কথা বলা হচ্ছে, কারণ এখনও পর্যন্ত সেরকম প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। আর যারা আক্রান্ত হন, তাঁদের মৃত্যুও ভয়াবহ হয়। জ্বর, মাথা ব্যথা দিয়ে শুরু; যত সময় এগোতে থাকে তত খিঁচুনি বাড়তে থাকে। শেষে নাক, মুখ থেকে ক্রমাগত রক্ত পড়তে থাকে। ভেতরেও পুরো ব্যবস্থাটা ভেঙে যায়। যার অবশ্যম্ভাবী ফল— মৃত্যু।

২০১৪ থেকে ২০১৬- এই লম্বা সময় এই ইবোলা ভাইরাস গোটা আফ্রিকাকে পর্যুদস্ত করেছিল। এই গোটা সময় আক্রান্ত হয়েছিল ২৮,৬৪৬ জন। যার মধ্যে ১১,৩২৩ জনই মারা যান। অর্থাৎ, হিসেব করলে, গোটা পৃথিবীতে ইবোলার আক্রান্তের মৃত্যুর হার প্রায় ৪০ শতাংশ! যা অনেকটাই বেশি। লিবেরিয়া, সিয়েরা লিওনে, নাইজেরিয়া, গিনি ইত্যাদি আফ্রিকান দেশগুলিতে মারাত্মক আকার নিয়েছিল। তবে গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যত্রও। আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ডেও পৌঁছে গিয়েছিল ইবোলা, কিন্তু মারাত্মক আকার নেয়নি। মহামারী দেখা দেয় শুধু আফ্রিকায়। সেখানকার অর্থনীতি, জীবন সমস্ত কিছুকে স্তব্ধ করে দেয়।

যে রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, সেই রোগের সঙ্গে লড়াই করা কঠিন। সেটাই করে দেখিয়েছিল আফ্রিকা। উপায়? আজকে ঠিক যেভাবে করোনা মোকাবিলা হচ্ছে, সেটাই। অর্থাৎ, রোগাক্রান্ত এলাকা ও ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ। সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ লকডাউন। যাতে কেউ কারোর সংস্পর্শে আসতে না পারে। রোগাক্রান্ত এলাকায় তো নয়ই। তাতে ছড়াতে পারবে না এই রোগ; আর আক্রান্তদেরও পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা করা যাবে। এদিকে মৃত্যুর হারও বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-সহ সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি গণ সচেতনতার কাজ করেন। আজও সেই কাজ সমানভাবে চলছে সব জায়গায়। যারা মারা গেছে, তাঁদের মৃতদেহের সংস্পর্শেও যেন কেউ না আসে। কারণ, এইভাবেই গিনি-তে আক্রান্ত হয়েছিলেন অনেকে।

সেইসঙ্গে ডাক্তারি পরীক্ষাও ছিল। যেহেতু কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি নেই এর, তাই ক্রমাগত পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছিল রোগীকে। ফ্লুইড রিপ্লেসমেন্ট একদম বন্ধ রাখা হয়েছিল। সমস্তটা লক্ষ্য রাখা হচ্ছিল ওপরমহল থেকে। ধীরে ধীরে সেই সংক্রমণ কমে আসে। ২০১৬-এর মাঝামাঝি ইবোলা মহামারী থামে আফ্রিকায়। কিন্তু এই রোগ এখনও উধাও হয়ে যায়নি। বিজ্ঞানীরা প্রতিষেধক বের করার চেষ্টা করে চলেছেন। তবে ইবোলা একটা জিনিস শেখায়। যদি আইসোলেশনের নিয়ম ঠিকঠাক মেনে চলা হয়, তাহলে সমস্ত কিছুই বাগে আনা সম্ভব। ইবোলাতেও অস্ত্র ছিল এটাই। আর আজ, করোনার ক্ষেত্রেও। এই যুদ্ধও জিতব আমরা। শুধু এটা নয়, আগামীদিনের লড়াইগুলোও…