মুক্তমঞ্চের অনুভূতি এবার ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি-তেই, রূপকথা না বাস্তব?

সেই মার্চ মাস থেকে শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি আগের মতো স্বাভাবিক কবে হবে, অথবা আদৌ হবে কিনা - সেই উত্তর সময় দেবে। নাটক-যাত্রা-গান-নাচ-আবৃত্তি প্রভৃতি মঞ্চ শিল্পী এবং এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পেশার মানুষের পরিস্থিতি আরও ভয়ানক। ভিড় এড়ানোর জন্য এতদিন সবকিছুই বন্ধ ছিল। এবারে একটু একটু করে আশার আলো ফুটছে বলে মনে হচ্ছে। সরকার ১ অক্টোবর থেকে মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিয়েছে। যদিও স্বাভাবিক কারণেই বেঁধে দেওয়া হয়েছে কিছু বিধি নিষেধ।  

কিন্তু সার্বিকভাবে এই ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যা কিনা বাঙালি মাত্রেই অত্যন্ত কাছের এবং যার উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের রুটি-রুজি, তার ভবিষ্যৎ কি? বিশেষত করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখলে, এবং যখন আমরা সকলেই জানি, এই পরিস্থিতি আমাদের সামলাতে হবে এখনও অনেকদিন। এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে করোনাকে নিয়েই আমাদের ঘর করতে হবে ভবিষ্যতেও। মুক্তমঞ্চের এই সমস্যা নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশেই ইতিমধ্যেই ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। এবং তার একটি সমাধানও এসেছে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি-র মাধ্যমে।

ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি বা সংক্ষেপে ভি-আর হল সেই প্রযুক্তি যার মাধ্যমে, শিল্পী এবং দর্শক দু-পক্ষের সামগ্রিক এক্সপেরিয়েন্সগুলো তৈরি করা যায় স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে যে-কোনো রকম দূরত্ব বজায় রেখেই। একটু উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝা যাক। 

মঞ্চের অনুষ্ঠানের মূল চাবিকাঠিই হল শিল্পী এবং দর্শকের মধ্যে সরাসরি যোগস্থাপন। একটা লাইভ অনুষ্ঠানে যে কোন দর্শক যে অনুভূতিগুলো প্রত্যক্ষ করেন, যেমন সরাসরি শিল্পীকে দেখতে পাওয়া, বন্ধু-বান্ধব এবং আরও হাজার হাজার মানুষের মধ্যে বসে সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করা, অনুষ্ঠানের ধর্ম অনুযায়ী চেঁচিয়ে-লাফিয়ে-হাততালি দিয়ে অথবা শিল্পীর সাথে গলা মিলিয়ে গান করা – এই সমস্ত কিছুই ঘরে বসে টেলিভিশনের পর্দায় বা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে সম্ভব নয়। একই ভাবে যে কোন শিল্পীর, মঞ্চে যে কোন পরিবেশনার মূল অনুপ্রেরণাই হল দর্শক। মঞ্চের সামনের কালো কালো মাথার উপস্থিতির অনুরণন সবসময় যে অনন্য মাত্রা যোগ করে, রুদ্ধদ্বার স্টুডিও অথবা নিরস ইউটিউব-ফেসবুক-যুম-স্ট্রিমইয়ার্ড লাইভ তা দিতে পারে না। শিল্পী মাত্রেই অনুষ্ঠানের শেষে দর্শকদের স্বতঃস্ফূর্ত অভিবাদনের উষ্ণতার পরিতৃপ্তি যে-কোনো বহুমূল্য উপহারের থেকেও দামি। ভি-আর-এর মাধ্যমে এই সমস্ত রকম অনুভূতিগুলো সৃষ্টি করা যায়। 

দর্শকশূন্য মাঠে খেলা হলেও খেলোয়াররা আজ সব সময় অনুভব করতে পারছেন দর্শকদের উপস্থিতি। এবছরের জুলাই মাসে আমেরিকার একটি এম এল বি (মেজর লিগ বেসবল)-এর খেলায় প্রথম ভার্চুয়াল দর্শক সৃষ্টি করে সকলকে চমকে দেয় ফক্স স্পোর্টস। তার পর থেকে একাধিক ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল ক্রাউড এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। লা লিগা, এন বি এ থেকে একেবারে হালের আই পি এল (ইন্ডিয়া প্রমিয়ার লিগ)। সি জি আই অ্যানিমেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল দর্শকে ভরে উঠেছে স্টেডিয়ামের আনাচ-কানাচ। তার সাথে যুক্ত হয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। কে এল রাহুল, এবি ডেভিলিয়ার্স-দের ব্যাটে চার বা ছয় কিংবা বুমরা, সামি-দের উইকেট ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠছে লক্ষ লক্ষ ডিজিটাল দর্শক। 

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও শুরু হয়েছে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি-র প্রয়োগ। ফরাসী সঙ্গীত শিল্পী জঁ মিশেল জাঁ (Jean-Michel Jarre) এই বছরের জুন মাসেই তার একটি অনুষ্ঠানে ভি-আর ব্যবহারের প্রাথমিক প্রয়োগ করেন। ফল পান হাতে নাতে। কানাডার পপ সঙ্গীতশিল্পী দ্য উইকএন্ড (আসল নাম এবেল ম্যাকোনেন টেসফায়ে) ভি-আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে অভুতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন ইতিমধ্যেই। বরং এক কদম এগিয়ে পরিসংখ্যান বলছে, ভি-আর-এর মাধ্যমে যেহেতু যে কোন ভৌগলিক দূরত্বকেও মুছে ফেলা সম্ভব, সেই কারণে পৃথিবীর সকল প্রান্তের দর্শকরা যুক্ত হতে পারেন এই অনুষ্ঠানে। ফলত দর্শক সংখ্যা বেড়ে গেছে বহুমাত্রায়। এর ফলে খুলে যেতে পারে আরেক দিগন্ত। আপনি ডালাসে বসে ডোভার লেন লাইভ শুনতে-দেখতে এবং অনুভব করতে পারবেন অথবা বেলঘরিয়ায় বসে ব্রডওয়ে থিয়েটারের নাটক দেখতে পারবেন। আবার একই সঙ্গে শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে পারে যে-কোনো অনুষ্ঠানের ব্যবসায়িক দিকেরও। ফলে অর্থনৈতিক ভাবে উপকৃত হবেন কলাকুশলীরাও।

সামাজিক-ভৌগলিক অথবা সময়ের দূরত্বকে মুছে ফেলতে দর্শককে মাথায় পরতে হবে ভি-আর হেডসেট নামক একটি যন্ত্র। যাতে দু-কানে দুটো মাইক্রোফোন লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে দুচোখে দুটি বিশেষ গগল্স লাগানোর ব্যবস্থা থাকবে। হেডসেট ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারে বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তে হতে থাকা লাইভ অনুষ্ঠানের সঙ্গে। এমনকি আপনার সোশ্যাল মিডিয়া ফিড থেকে খুঁজে নিয়ে আপনাকে ভার্চুয়ালি দেখা করিয়ে দেবে আপনার বন্ধুর সঙ্গে। তার মানে আপনি শ্যামবাজারে নিজের ড্রয়িং রুমে বসে সিডনি অপেরা উপভোগ করতে পারবেন সিঙ্গাপুরে থাকা আর এক বন্ধুর সঙ্গে। 

ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি-র সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে অগ্মেন্টেড রিয়্যালিটি (এ-আর)কেও। যার মাধ্যমে সৃষ্টি করা যেতে পারে আরও পার্থিব অনুভূতি। শিল্পী গান গাইতে মঞ্চের সামনে এগিয়ে এসে দর্শকদের হাত ছুঁলেন। সেই উষ্ণতা অনুভব করতে করতে পারেন আপনিও, এ-আর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। 

প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা পেতে পারি এমন এক পন্থা, যাতে মানুষের ভিড় এড়ানো যায় অথচ সব রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতে পারে। রূপকথার মত শুনতে লাগলেও ভি-আর এবং এ-আর এখন ঘোর বাস্তব। 

এবারে প্রশ্ন উঠতে পারে ভারতের মত ‘গরিব’ দেশে এর রূপায়ণ কতটা বাস্তবসম্মত। গ্রামে গঞ্জে হাজার হাজার মাচার অনুষ্ঠান কী এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যুক্ত করা সম্ভব। 

তাহলে বলতে হবে আজ থেকে আট-দশ বছর আগেও আমাদের দেশের আমজনতার পকেটে পকেটে স্মার্ট ফোনও ছিল অলীক স্বপ্ন। আর এখানেই চলে আসে আয়োজক সংস্থাগুলোর এবং অবশ্যই সরকারের ভূমিকা। বড় বড়ো শহরে এবং বড়ো বড়ো অনুষ্ঠানে যেখানে বাজেটের সমস্যা নেই, সেখানে ডিজিটাল দর্শক এবং ভি-আর স্ট্রিমিং-এর পরিকাঠামো রূপায়ণ করতে খুব বেশি সমস্যা হওয়া উচিত নয়। দরকার সঠিক পরিকল্পনা আর যোগ্য প্রযুক্তি সংস্থার। 

স্পটিফাই, অ্যাপেল মিউজিক, ইউটিউব প্রভৃতি সংস্থা বেশ কিছুদিন আগেই ভি-আর স্ট্রিমিং শুরু করেছে। পিছিয়ে নেই ভারতীয় সংস্থা গানা ডট কমও। গুগ্ল কার্ডবোর্ড, সোনি গিয়ার, স্যামসাং প্লে-স্টেশন অথবা অক্যুলাস রিফট, এইচ টি সি ভাইভ জাতীয় ভি-আর হেডসেট-এর চল শুরু হয়েছে আমাদের দেশেও। 

প্রযুক্তির উন্নতি মানুষকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-বিনোদন উপহার দেওয়ার সঙ্গে অযাচিত ভাবে নিমন্ত্রণ করে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যারও। মনে রাখতে হবে আপাতভাবে যা প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করছি সেটা ভার্চুয়াল। এবং তার সঙ্গে কখনোই আমাদের চারপাশের প্রকৃত বাস্তবকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। ভি-আর হেডসেট-এর অতিরিক্ত ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে আমাদের। 

ভি-আর হেডসেট ব্যবহারের আধিক্যজনিত ফল সৃষ্টি করতে পারে দূরত্ববোধের অভাব। কোন রোলার কোস্টার রাইডে ভ্রমণ করার পর ছন্দে ফিরতে যেমন একটু সময় লাগে এক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। আপনার গতি-অসুস্থতা থাকলে ভি-আর হেডসেট ব্যবহার বুঝে করাই ভালো। শিশু-কিশোরদের জন্য ভি-আর হেডসেটের ব্যবহার অবশ্যই বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে করা উচিত। পাবলিক প্লেসে এর ব্যবহার নৈব নৈব চ।

যে-কোনো ভি-আর নির্মাতা সংস্থার নির্দেশাবলীতে একটানা তিরিশ মিনিটের বেশি ভি-আর হেডসেট পরে থাকার ব্যাপারে সতর্কবার্তা দেওয়া থাকে। অনেকক্ষণ একটানা কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিন ব্যবহার করলে যেমন দৃষ্টিতে অস্বচ্ছতা আসতে পারে, এক্ষেত্রেও তা সম্ভব। 

তবে এ সমস্ত কিছুই প্রযুক্তির অতি ব্যবহারের ফল। পরিমিত ব্যবহার এবং নির্দেশিত পন্থা অনুসরণ করলে অসুবিধা হওয়া উচিত নয়। কার্যত আমরা বিনোদন দুনিয়ার একটি দিক নিয়ে আলোচনা করছি, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদাগুলো নিয়ে নয়। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে আগামী দিনের বিনোদনের নতুন দিগন্ত খুলে যেতে পারে এই প্রযুক্তির হাত ধরে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More