বিশাখাপত্তনমের গ্যাস দুর্ঘটনা : সভ্যতার ‘স্বরূপ’ ও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

৩৬ বছরের পুরোনো দুর্ঘটনার স্মৃতি ফিরে এল আবার। রাতারাতি বদলে গেল বিশাখাপত্তনমের ছবি। ভাইজাগের এলজি পলিমার কারখানার ট্যাঙ্ক থেকে ছড়িয়ে পড়ল বিষাক্ত স্টাইরিন গ্যাস। গতকাল মধ্যরাতেই কারখানার পাইপ ফেটে বেরোতে থাকে বিষাক্ত গ্যাস। অজ্ঞান হয়ে যান বেশ কিছু কর্মচারী। সাইরেন বেজে ওঠে এলজি কেমিক্যালে। কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের আগেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে স্টাইরিন। এখনও অবধি মারা গেছেন ১১ জন মানুষ। আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশি। ভাইজ্যাকের হাসপাতালগুলি ভরে গেছে গ্যাসের প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষে। বয়স্ক এবং শিশুদের প্রাণ বাঁচাতে দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করছেন বাড়ির লোক।

স্টাইরিনের রাসায়নিক নাম ইথাইল বেঞ্জাইন। এই রাসায়নিক পদার্থ দিয়েই প্লাস্টিকজাত পলিমার ও রেজিন তৈরি হত ওই কারখানায়। বিষাক্ত স্টাইরিন অল্প পরিমাণে শরীরে ঢুকলেও জ্ঞান হারাতে পারে মানুষ। সঙ্গে দেখা দিতে পারে বমিভাব বা মাথাঘোরার মতো উপসর্গ। তবে এখানেই কী শেষ? ভাইজ্যাকে যে পরিমাণে স্টাইরিন বাতাসে মিশেছে তার পরিণতি আন্দাজ করেই আঁতকে উঠছেন বিশেষজ্ঞরা। শ্বাসতন্ত্র, খাদ্যনালীকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে এই গ্যাস। স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে স্নায়ুতন্ত্রেও। এই সময় প্রাণে বাঁচলেও রক্ষা নেই মানুষের। পরবর্তীকালে দেখা দিতে পারে ব্লাড ক্যানসার বা লিউকোমিয়ার মতো রোগ।

মানুষ ছাড়াও অন্যান্য বহু পশুপাখির মৃত্যু হয়েছে ইতিমধ্যেই। এমনকি বদলে গেছে গাছের পাতার রং। ভাইজাগের ছবি এখন এতটাই ভয়ঙ্কর। ওই কারখানা ঘিরে ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের সমগ্র অঞ্চলের মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্যত্র। বলা হচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সত্যিই কি নিয়ন্ত্রণে এসেছে পরিস্থিতি? যাঁরা প্রাণে বাঁচলেন, তাঁদের লড়াই সত্যিই কি শেষ?

১৯৮৪-তে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে বেসরকারি গণনায় মৃতের সংখ্যা ছিল এর প্রায় তিনগুণ। এমনকি গর্ভস্থ শিশুরাও মারা গেছিল দুর্ঘটনায়। স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হন চার হাজারের বেশি মানুষ। এই ঘটনার পরই তৈরি হয়েছিল দূষণ নিয়ন্ত্রণের নানান আইন। রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির জন্য বানানো হয়েছিল বিশেষ বিধি। একটি বিপর্যয়ের ৩৬ বছর পরেও আমরা কি এগোতে পেরেছি তার থেকে? কার্যত কাগজেই বন্দি রয়ে গেছে সেসব বিধি-নিষেধ। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চলছে রাসায়নিক কারখানাগুলির দৌরাত্ম্য। ভাইজ্যাকের এলজি ক্যামিকাল প্রমাণ দিল তারই।

যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাঁদের অনেকেই ওই কারখানার কর্মচারী। স্পষ্টতই এখান থেকে উঠে আসে, শ্রমিকদের জন্যেও ন্যুনতম প্রোটেকশন ছিল না কোনো। এছাড়াও দুর্ঘটনা ঘিরে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে সংস্থার গাফিলতির চিহ্ন। পুলিশ অভিযোগ জানায় লকডাউনে কারখানার রক্ষণাবেক্ষণ বন্ধ ছিল পুরোপুরি। তার পরে হঠাৎ করে পুরোদম কাজ চালাতে গিয়েই ঘটে দুর্ঘটনা। তবে এই অভিযোগকে স্বীকার করেননি সংস্থার আধিকারিকরা।

শুরু হয়েছে তদন্ত। কাজে হাত লাগিয়েছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। কিন্তু এসবের পিছনে মারা যাবেন বহু মানুষ। অনেকে ক্ষত’র দাগ বয়ে নিয়ে বেড়াবেন বছরের পর বছর। সেই ক্ষতের দামই ঠিক করা হয়েছে পরিবার পিছু ১ কোটি টাকা। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কেউ পাবে কি আদৌ? ঠিক যেভাবে ভোপালে ঘটনার পরের দিনই বহুজাতিক সংস্থার মালিক দেশ থেকে পালিয়ে আমেরিকা চলে গেছিলেন। আজও তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি আইন। ভাইজ্যাকের ক্ষেত্রেও তার অনেকটাই এক। কতটা দায় স্বীকার করবে এই সংস্থা? কেনই বা করবে? কারণ শিল্পের মূলমন্ত্রই হল লাভ। পরিবেশের ভারসাম্য এবং সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যে কতটাই বা আসে যায় তাতে?

সভ্যতা যত এগিয়েছে উন্নত হয়েছে প্রযুক্তি। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই মানুষ আয়ত্ত করেছে দুঃসাধ্যকে। ক্ষতিকর দিক জেনেও প্রশ্রয় দিয়েছে দূষণকে। বিজ্ঞান এবং অগ্রগতির দম্ভে ক্রমাগত অবহেলা করে গেছে পরিবেশকে। অনেক কারখানাতেই পলিউশন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলি নিছকই শো-পিস মাত্র। সর্বোচ্চ লাভের কথা বিচার করতে গিয়েই সভ্যতা যেন কোথাও উপেক্ষা করে যাচ্ছে বিজ্ঞানকে। থ্রি মাইল, চার্নোবিল, ভোপাল, ডিপওয়াটার হরাইজোন স্রেফ উদাহরণ হয়েই রয়ে গেছে ইতিহাসে। তাতে বিন্দুমাত্র হেলদোল হয়নি সভ্যতার। সচেতন হয়নি মানুষ।

সভ্যতা এগিয়ে নিয়ে যেতে শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু সতর্কতার কথা বিন্দুমাত্রও মনে রাখতে পারি না আমরা। চোখে আঙুল দিয়ে সেটাই দেখিয়ে দিল বিশাখাপত্তনমের দুর্ঘটনা। পাশাপাশি এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ছত্তিশগঢ়ের কাগজ কারখানায় আরো একটি গ্যাস দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ৭ জন। প্রশ্ন একটাই। ঠিক কতোগুলো বিপর্যয়ের পরে আমরা আয়ত্ত করব সচেতনতা? ঠিক কত মানুষের মৃত্যু দেখতে হবে ততদিন?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

More From Author See More