মাটির তলায় ‘গুপ্ত’ শহর, কোন বিপদের প্রস্তুতি?

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি এক সুন্দর শহর। বুক চিরে বয়ে গেছে একফালি নদী। সারা বছর লেগে থাকে পর্যটকদের ভিড়। জর্জিয়া (Georgia) দেশের রাজধানী তবলিসির খ্যাতির একটা বড়ো কারণ যদি তার নিজস্ব সৌন্দর্য হয়, তবে আরেকটি কারণ লুকিয়ে আছে মাটির তলায়। কারণ, এই শহরের গভীরে বসে রয়েছে একটি আস্ত শহর। যেন, তবলিসিকে (Tblisi) উলটে দিলেই সামনে চলে আসবে সেই ভূগর্ভস্থ নগরী। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঠান্ডাযুদ্ধের সময়কার উদ্বেগজনক ইতিহাস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন আমেরিকা ও সোভিয়েতের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়, তখন দুদেশই শুরু করে উপযুক্ত প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি। বিশেষ করে ১৯৪৫-এ জাপানে বিস্ফোরিত পরমাণু বোমার শক্তি আশঙ্কিত করেছিল সারা বিশ্বের মানুষকে। ১৯৪৯-এ সোভিয়েতের পরমাণু বোমার পরীক্ষাও সমস্ত বিপদ মাথায় নিয়ে সফল হয়। আজকের জর্জিয়া দেশটি তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে ছোটো এক প্রদেশ। মূলত প্রাকৃতিক উপাদানে সমৃদ্ধির জন্যই পরিচিতি। সোভিয়েতের প্রতিরক্ষা দপ্তর তাই তবলিসিকেই বেছে নিল উচ্চপদস্থ রাশিয়ান আধিকারিকদের নিরাপত্তার জন্য। একই সঙ্গে এখান থেকেই চলবে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। আর সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি হয় এই ভূগর্ভস্থ শহর।

ঠিক কী আছে এখানে? বরং প্রশ্ন করা চলে কী নেই! মানুষের বাঁচার জন্য ন্যূনতম যা যা প্রয়োজন, সব ব্যবস্থাই কমবেশি করে রেখেছিল রাশিয়ানরা। টানা কয়েকশো শয়নকক্ষ, চলাচলের জন্য বৃহদাকার এক টানেল, চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো, জলের লাইন সবই আছে এখানে। সাড়ে চারশোর বেশি বাঙ্কার ছিল আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য। এমনকি ট্রলি জাতীয় ট্রেন চলাচলের জন্য একটা ছোটো রেলপথও রয়েছে শহরটিতে। তবে, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কন্ট্রোলরুমটি। পূর্ব-ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাবতীয় তথ্য আদানপ্রদান হত মাটির তলার এই ঘর থেকেই। 

ফলে সামান্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নিলেই যেন আবার নতুন করে বসতি গড়ে তোলা যায় এখানে। হ্যাঁ, বন্য পশুপাখিরা বাসা বেঁধেছে মাটির তলায়। ১৯৯১-তে সোভিয়েতের পতনের পর অন্যান্য বহু দেশের মতো স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করে জর্জিয়া। যুদ্ধবিগ্রহ ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কালো অধ্যায়কে পিছনে ফেলার জন্য এই বাঙ্কার নগরীকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সে দেশের সরকার। সেই থেকে অবহেলিত হয়ে আছে এটি। পরিচর্যার অভাবে কিছু অংশ ভেঙে পড়লেও, মূল কাঠামোটি দিব্যি শক্তপোক্ত রয়েছে। তার কারণও আছে। সোভিয়েতের স্থাপত্যকর্মীদের দাবি ছিল এই শহরটি অন্যান্য বোমা তো বটেই, পারমাণবিক বোমার থেকে পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে। সৌভাগ্য যে, সেই পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। শুধুই চাপা টানাপোড়েন আর যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবের মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে এতগুলি বছর। জর্জিয়াও মুক্ত থেকেছে সমস্ত রকম বিপদ থেকে। তবে কয়েক দশক আগে এখানে নিয়মিত আগমন ঘটত রাশিয়ার রাজনৈতিক নেতাদের। গোয়েন্দা দপ্তরের বিভিন্ন গোপন আলোচনাও সংঘটিত হত এই শহরে।

আরও পড়ুন
বাস্তবের প্রেরণাতেই তৈরি ব্যাটম্যানের শহর ‘গথাম’

তবে সাধারণ মানুষ কিংবা পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ এখানে। পর্যাপ্ত কারণ দেখিয়ে, সরকারের বিশেষ পারমিশন নিয়ে প্রবেশের অনুমতি পান গবেষক-সাংবাদিকরা। তাও শুধুমাত্র কিছু সীমিত স্থানে। নতুবা আজও চূড়ান্ত গোপনীয়তা চলে বাকি ঘরগুলি নিয়ে। একটা অংশের অবশ্য মত যে, ভবিষ্যতে কোনো বড়োসড়ো যুদ্ধ লাগলে ফের ব্যবহার করা যেতে পারে বাঙ্কারটি। হয়তো ভুল নয় এই তত্ত্ব। বর্তমান পৃথিবী যেভাবে আগুনের পিণ্ডের উপর বসে আছে, তাতে তো এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর শুধু জর্জিয়া কেন, পৃথিবীর সব দেশই তখন ঢুকে যাবে মাটির তলায়। সেটা জীবিতভাবে বাঙ্কারে হোক, নয়তো ধুলোয় বিলীন হয়ে।

আরও পড়ুন
আজ থেকে ৭০ বছর আগেও গুহায় বাস করত ‘লজ্জা’র শহরের বাসিন্দারা

Powered by Froala Editor