‘অভিশপ্ত’ এই গাছকে কেন্দ্র করেই বাঁধতে চলেছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ!

বারাক ওবামা, বরিস জনসন কিংবা অ্যাঞ্জেলা মর্কেল— বিভিন্ন সময়ে বৃক্ষরোপণ করতে দেখা গেছে বিশ্বের খ্যাতনামা রাষ্ট্রনেতাদের। না, কোনো পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করতে নয়, বরং শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতেই এহেন উদ্যোগ। সাদা গোলাপের মতোই, কখনও কখনও গাছই হয়ে ওঠে শান্তির বার্তাবাহক। তবে গাছের কারণেই যদি যুদ্ধ বাঁধে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে? 

হ্যাঁ, এমনই আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৬ সালে। একটি গাছ (Tree) নিয়েই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকান এবং উত্তর কোরিয়ান (North Korea) সেনারা। না, তখনও পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠেনি। তবে রাশিয়া এবং চিনের পূর্ণ সমর্থন ছিল তাদের পক্ষে। ফলে, তৎকালীন বিশ্বের বহু যুদ্ধ-বিশ্লেষকরাই ভেবেছিলেন, সামান্য গাছ নিয়ে এই বিবাদ ঠান্ডাযুদ্ধকে চেহারা দিতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ট্রিগার করতে পারে পারমাণবিক সংঘাত। 

শুরু থেকেই বলা যাক ঘটনাটা। ১৯৫৩ সাল। ‘জয়েন্ট সিকিওরিটি এরিয়া’ ও ‘ডিমিলিটারাইজড জোন’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ইতি পড়ে রক্তক্ষয়ী কোরিয়ান যুদ্ধের। অবশ্য তারপরেও থামেনি দুই দেশের বিবাদ। একাধিকবার দক্ষিণ কোরিয়ায় হানা দিয়েছে আগ্রাসী উত্তর কোরিয়ার সেনারা। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়াকে প্রতিরক্ষা প্রদানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সেনা প্রত্যাহার করেনি কোরিয়ান সীমান্ত থেকে। 

সমস্যার সূত্রপাত হয় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে একদল সেনা ৭ মার্কিন আধিকারিককে অপহরণ করে নিয়ে যায় নিজেদের দেশে। তবে এই গোটা বিষয়টিই মার্কিন ও দক্ষিণ কোরিয়ান সেনাদের নজরে আসেনি। আর তার কারণ একটি প্রকাণ্ড পপলার গাছ। ডিমিলিটারাইজড জোনে অবস্থিত এই গাছের কারণে ঢাকা পড়ে যেত উত্তর কোরিয়ায় অবস্থিত একটি সামরিক সাঁকো। উল্লেখ্য, সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় ঢোকায় একমাত্র রাস্তা ছিল এটিই। 

যাই হোক, পাল্টা সামরিক অভিযান চালিয়ে সে-যাত্রায় অপহৃত আধিকারিকদের ছাড়িয়ে আনতে পারলেও, যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট পপলার গাছটি। সেনা আধিকারিকরা সিদ্ধান্ত নেন, কেটে ফেলা হবে এই গাছ। সেনার এই সিদ্ধান্তে শিলমোহরও চাপায় মার্কিন সরকার। শান্তিচুক্তি মেনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানিয়েও দেওয়া হয় উত্তর কোরিয়াকে। তবে বেশ কয়েকদিনেও উত্তর কোরিয়ার তরফ থেকে কোনো উত্তর না আসায়, বাড়তি অপেক্ষা না করেই অভিযান শুরু করে মার্কিন সেনারা। 

১৮ আগস্ট, ১৯৭৬ সাল। লেফটেন্যান্ট বনিফাসের নেতৃত্বে শুরু হয় পপলার গাছ কাটার এই ‘দুঃসাহসিক’ মিশন। হ্যাঁ, দুঃসাহসিকই বটে। কারণ, উত্তর কোরিয়ার মতো আগ্রাসী প্রতিপক্ষের সামনে কোনোরকম আগ্নেয়াস্ত্র না নিয়েই ডিমিলিটারাইজড জোনে প্রবেশ করেছিলেন বনিফাস। সঙ্গে ছিলেন ৩০ জন দক্ষিণ কোরিয়ান ও মার্কিন সেনা। হাতিয়ার বলতে তাঁদের কাছে ছিল কেবলমাত্র গাছ কাটার কুঠার। 

প্রাথমিকভাবে নির্ঝঞ্ঝাটে এই কাজ চললেও, ঘণ্টা খানেক বাদেই বনিফাসকে বাধা দেন উত্তর কোরিয়ান লেফটেন্যান্ট পাক চুল। দাবি ছিল, সংশ্লিষ্ট গাছটি নাকি রোপণ করেছিলেন স্বয়ং সে-দেশের সর্বাধিনায়ক কিম ইল-সুং। ফলে, এই গাছ কাটা যাবে না। অবশ্য তাঁর কথায় কান দেয়নি মার্কিন সেনারা। এর মিনিট দশেকের মধ্যেই রক্তক্ষয়ী চেহারা নেয় পরিস্থিতি। লোহার রড, ধারালো অস্ত্র এবং মুগুর নিয়ে মার্কিন সেনাদের হামলা করে পঞ্চাশের বেশি উত্তর কোরিয়ান সেনা। ঘটনাস্থলেই মারা যান বনিফাস। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাকি সেনারাও আহত হয়েছিলেন গুরুতরভাবে। 

এই ঘটনার ঠিক পরই উত্তর কোরিয়ার সংবাদমাধ্যম প্রচার শুরু করে তাদের দেশে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ‘উচিত জবাব’-ও দেওয়া হয়েছে তাদের। এমনকি মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যেই গোটা ঘটনার আনুষ্ঠানিক সামরিক রিপোর্ট প্রকাশ করে উত্তর কোরিয়ার সামরিক শাসক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর অভিমত ছিল, মার্কিন সেনাদের আগাম বার্তা পেয়েও ইচ্ছাকৃতভাবেই তার উত্তর দেয়নি উত্তর কোরিয়া। বরং, সেই সুযোগে পরিকল্পিতভাবেই সাজিয়েছিল এই আক্রমণের ফন্দি। না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবি, অবিশ্বাসযোগ্য বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, যখন এই বিবাদ হয়, তখন উত্তর কোরিয়ার সর্বাধিনায়ক শ্রীলঙ্কায়। অংশ নিয়েছেন এক জরুরি বৈঠকে। তা সত্ত্বেও, পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়া মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট প্রকাশ কি সম্ভব? 

তবে উত্তর কোরিয়ার এই চোখ রাঙানিতে চুপ করে বসে থাকেনি যুক্তরাষ্ট্রও। বরং, ৩ দিন পর পাল্টা আঘাত হানে তারা। গোটা বিশ্ব সাক্ষী হয়েছিল আশ্চর্য এক সামরিক অভিযানের। অপারেশন পল বুনিয়ান। একটি গাছ কাটার জন্য ২ ব্যাটেলিয়ান পদাতিক সেনা, ২ ব্যাটেলিয়ান ইঞ্জিনিয়ার, অসংখ্য সাঁজোয়া গাড়ি, হেলিকপ্টার নিয়ে অভিযান শুরু করে আমেরিকা। বড়ো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই দক্ষিণ কোরিয়ায় অ্যাক্টিভেট করা হয়েছিল একাধিক বোমারু বিমান। ইয়েলো সি-তে এসে হাজির হয়েছিল আমেরিকার বিমানবাহী জাহাজ ‘মিডওয়ে’। তাছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়ায় বাড়তি ১২ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছিল পেন্টাগন। 

হ্যাঁ, এবারেও বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল উত্তর কোরিয়া। মেশিনগান এবং রাইফেল-ধারী দেড়শো থেকে দুশো সৈন্য সীমান্তে পাঠিয়েছিল তারা। তবে ততক্ষণে ডিমিলিটারাইজড জোনে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে মার্কিনিরা। অন্যদিকে বাড়তি সাহায্যের কোনো ব্যবস্থা করে রাখতে পারেনি উত্তর কোরিয়া। এমনকি সোভিয়েতের থেকেও সেবার বড়ো কোনো সাহায্য পায়নি তারা। ফলে, বিপুল সৈন্যসজ্জা দেখে চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাদের। 

মাত্র ৪২ মিনিটের মধ্যেই কাজ শেষ করে মার্কিনিরা। বৈদ্যুতিক করাতের মাধ্যমে কেটে ফেলে ‘অভিশপ্ত’ পপলার গাছটি। তৎকালীন মার্কিন সেনা আধিকারিকরা অনেকেই স্মারক হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন সেই গাছের ডাল-পালা। অন্যদিকে প্রকাণ্ড গাছটির ২০ ফুট লম্বা কাণ্ডটি অবশিষ্ট রাখা হয়েছিল যুদ্ধচিহ্ন হিসাবে। 

অপারেশন পল বুনিয়ানের পর অবশ্য খানিকটা হলেও নরম হয় উত্তর কোরিয়া। ‘ভুল বোঝাবুঝি’-র তকমা দেয় রক্তক্ষয়ী সংঘাতকে। অবশ্য রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশ সত্ত্বেও, সেই দ্বন্দ্বে প্রাণ হারানো সামরিক আধিকারিকদের পরিবারকে আজও কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি উত্তর কোরিয়া। তবে গাছ নিয়ে এই দ্বন্দ্ব যে বৃহত্তর যুদ্ধের রূপ নেয়নি, সেটাই কি কম লাভজনক? 

Powered by Froala Editor