দিনে ৩৫ কেজি খাবার একাই আত্মসাৎ করতেন গুজরাটের এই শাসক!

বাড়িতে খাবার আনার জো নেই। চোখের নিমেষে হাঁড়ি ভর্তি দই, ক্ষীরের নাড়ু, মিষ্টি— সবই গলাধঃকরণ করে গেলে হরিপদ। সেভাবেই গোটা কয়েক নাড়ু খেয়ে ফেলে হরিপদ জানতে পেরেছিল তাতে মেশানো রয়েছে ইঁদুর মারা সেকো বিষ। না, প্রাণহানি হয়নি। এমনকি কোনো বিষই মেশানো ছিল না নাড়ুতে। বরং, হরিপদর ‘খাই খাই ব্যারাম’ ঠেকাতেই গোটা ব্যাপারটা সাজিয়েছিল তার দুই মামা। 

সুকুমার রায়ের লেখা ‘পেটুক’ শীর্ষক এই গল্প পড়তে পড়তে অনেকেরই মনে হতে পারে, সত্যিই কি বাস্তবে এত খারাপ কেউ আত্মসাৎ করতে পারে একদিনে? হ্যাঁ, সাধারণ মানুষ না-পারলেও, এই ভূ-ভারতের ইতিহাস ঘাঁটলেই খুঁজে পাওয়া যাবে এমন সব আশ্চর্য চরিত্রদের, যাঁরা কয়েক কেজি খাবার খেয়ে ফেলতে পারতেন একাই। আর সেই তালিকার অন্যতম একজন গুজরাটের শাসক শাহ মাহমুদ বেগাদা।

আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। ১৪৫৮ থেকে ১৫১১ সাল— প্রায় ৫৩ বছর গুজরাটে রাজত্ব করেন মুজফরিদ শাসক দাউদ খানের উত্তরসূরি মাহমুদ শাহ (Mahmud Shah)। এমনকি রাজত্বকালের নিরিখে দেখলে গুজরাটের (Gujrat) ‘দীর্ঘতম’ শাসকও তিনি। তবে দীর্ঘতম শাসনকাল বা বীরত্বকাহিনি নয়, বরং মাহমুদ বেগাদা ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন তাঁর পেটুক স্বভাবের জন্য। গুজরাতি এই সুলতানের দৈনন্দিনের খাদ্যতালিকা শুনলে চোখে কপালে উঠতে বাধ্য যে-কারোর। 

প্রাতরাশ থেকেই শুরু করা যাক সেই বর্ণনা। দেহ সুস্থ ও সবল রাখতে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কলা দিয়ে প্রাতরাশ সারতেন মাহমুদ শাহ। দু-একটি নয়, একসঙ্গে ১৫০টি পাকা কলা লাগত তাঁর। সঙ্গে এক বাটি মধু ও গাওয়া ঘি কিংবা মাখন। তবে তাতেই যে খিদে মিটত তাঁর, এমন নয়। সুলতানের জন্য সবসময় প্রস্তুত রাখতে হত মাংসের পুর দেওয়া গরম শিঙাড়া। খানিক বাদে বাদেই একটি করে শিঙাড়া মুখে পুরতেন তিনি। সকাল থেকে রাত অবধি— সবমিলিয়ে নাকি দু-থালা শিঙাড়া সাবাড় করে দিতেন শাহ মাহমুদ। যার মোট ওজন ৪-৫ কিলোগ্রাম। 

এ-তো গেল খাবারের খুচরো হিসেব। মধ্যাহ্নে বা রাত্রের আহারেও থাকত পঞ্চব্যাঞ্জন। যার একটা বড়ো অংশ ছিল কেবলমাত্র মিষ্টি। বাসমতী চালের পায়েস থেকে শুরু করে, ক্ষীর, দই-সহ গোটা দিনে অন্তত সাড়ে ৪ কেজি মিষ্টি খেতেন গুজরাতি সুলতান। এমনকি তাঁর খাদ্যতালিকা থেকে বাদ পড়ত না বিষও। প্রতিদিন কম-বেশি বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্নধরনের বিষসেবন করতেন শাহ মাহমুদ। কখনও ঠান্ডা পানীয়ের সঙ্গে মিশিয়ে, কখনও আবার তাঁর জন্য বিশেষভাবে তৈরি রান্নাতেই মেশানো হত বিষ। 

ওই-যে কথায় আছে, বিষে বিষে বিষক্ষয়। এই ব্যাপারটা তেমনই। সে-যুগে বহু শাসকই খাবারের সঙ্গে স্বল্প পরিমাণ বিষ খেতেন বিষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময় থেকেই দেখা যায় এহেন উদাহরণ। শাহ মাহমুদের ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি তার। তবে দৈনন্দিন প্রায় ৩৫ কিলো খাবার আত্মসাৎ করার কারণে, তাঁর বিষসেবনের পরিমাণও ছিল ধারণার বাইরে। ফলে, বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল খোদ সুলতানের শরীরও। তাঁর গায়ে বসলেই নাকি প্রাণ হারাত পতঙ্গরা। এমনকি তাঁর লালারসও ছিল তীব্র বিষাক্ত। কখনও কখনও তিরের অগ্রভাগেও মারণ ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হত তাঁর লালারস। 

শাহ মাহমুদের এই বর্ণনা অত্যুক্তি বলেই মনে হতে পারে অনেকের। কেউ আবার রূপকথার গল্প বলেও মনে করতে পারেন সুলতানের এই বর্ণময় জীবনকে। তবে তৎকালীন সময়ের একাধিক ঐতিহাসিক নথিতেই লিখিত রয়েছে এই আশ্চর্য সব ঘটনার কথা। পারস্যের বিভিন্ন কাহিনিকারের লেখা থেকে শুরু করে ইউরোপীয় পর্যটক লুডোভিকো দি ভার্থেমা এবং দুয়ার্ত বারবোসার ভ্রমণবৃত্তান্তেও দেখা যায় এই আশ্চর্য বর্ণনা। লেখার ভাষা ও সময় পৃথক হলেও, এক আশ্চর্য মিল রয়েছে উভয়ক্ষেত্রেই। ফলে নিতান্ত বুজরুকি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না এই ঘটনাকে। পাশাপাশি পরবর্তীকালে, সপ্তদশ শতকে স্যামুয়েল বাটলারের লেখা ‘হুডিব্রাস’-এও পাওয়া যায় শাহ মাহমুদের কাহিনি। 

অবশ্য শুধু ভোজন ও বিলাসপ্রিয়— এই শব্দ দুটি শাহ মাহমুদের চারিত্রিক বর্ণময়তাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট নয়। তার কারণ, গুজরাটের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসাবেও চিহ্নিত করা হয় এই ইসলাম শাসককে। পরধর্মর প্রতি সম্মান, রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে অদ্বিতীয় ছিলেন তিনি। প্রজাবৎসল হিসাবেও যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে তাঁর। এমনকি পর্তুগিজদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে রাজত্বের একাংশ হারালেও গুজরাটের মাটি ছেড়ে বিদায় নেননি তিনি। তবে এইসবের বাইরে গিয়ে শাহ মাহমুদের জনপ্রিয়তা সীমিত রয়ে গেছে তাঁর খাদ্যতালিকাতেই ও ভোজনরসিকতাতেই। 

Powered by Froala Editor