সর্বস্ব খুইয়েও, উত্তরণের দিকে এগিয়ে যাওয়াই জীবন – ‘মানুষ’ চিনিয়ে দিল তা

একটা নাটক দেখে ও দেখায়। দেখা স্বচ্ছতা থাকলে দেখানোরও থাকবে। এটা সম্পর্কিত ব্যাপার। লেখক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, আলোকসম্পাতকারী - এঁদের ভেতরকার সেতু হল দেখার সেই চোখগুলো, যাকে দেখার দৃষ্টি বলে। তা নইলে নাটকের মতো সর্বাত্মকভাবেই একটি মাল্টিপোলার আর্ট দাঁড়ায় না। গত শুক্রবার সন্ধেয় ই.এস.আই. সল্টলেক অডিটোরিয়ামে প্রফুল্ল রায়-এর গল্প অবলম্বনে নান্দীকার প্রযোজিত 'মানুষ' নাটকের অভিনয় দেখে এই কথা মনে হল। রসতত্ত্বের ভাষায় যাঁদের 'সহৃদয় হৃদয়সামাজিক' বলে, তাঁদের সকলেরই এ-কথা মনে হবে, আমার বিশ্বাস।

এই নাটকে তিনটে সামাজিক স্তর রয়েছে। দু'দিকে শহর ও প্রত্যন্ত এবং শহরকে যা প্রত্যন্ত সম্পর্কে অচ্ছুৎ ভাবায় অথবা প্রত্যন্তকে যা শহর নিয়ে স্বপ্ন দ্যাখায়, এমন এক বিভাজক পাহাড়। শহরের নাম এখানে পূর্ণিয়া, পাহাড়ের নাম শিরমুণ্ডি। এসব নাম খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় এখানে, কেননা এরা প্রতিনিধিত্ব করছে মাত্র। শাদা দেশ, কালো দেশ, বিশ্বের সর্বত্র এই স্তরীয় বিন্যাস ঠিক এভাবেই বিন্যস্ত থাকে। তখন শহর, গ্রাম, পাহাড়, বন, শহুরে, গ্রামীণ, বন্য এই সমস্ত ট্যাগ হয়ে পড়ে সাধারণ বিশেষ্য, হয়ে পড়ে প্রতীক। এই নাটকটি অবদমিতের পথ, মহাভারতের পথ ধরে আসা লড়ুয়ে মানুষদের গল্প নিয়ে বাঁধা। তাদের শ্রেণী-লড়াই, ভাতের লড়াই, ভালোবাসার লড়াই, অস্তিত্বের লড়াই, নাগরিকত্ব প্রমাণের চিরায়ু লড়াই 'ছিনকে লেঙ্গে আজাদি'-র সুরের মতো পৃথিবীর সকল আকাশে ছড়িয়ে পড়ে।

নাটকের প্রধান চরিত্রের নাম ভরসা, 'জঙ্গল কা হাঁকুয়া' ভরসা লাল। এই এলাকা শহরের করুণা যতটা পৌঁছোয়, তার বাইরে। অদ্ভুত আঁধার এক সেখানে নামেনি তখনও। তাই সরকারি পরিষেবা আসার পথ চেনে না। অথচ রাষ্ট্রের প্রতারণা পৌঁছনোর এটাই সহজ, স্বাভাবিক ও সম্ভাব্য পথ। এরকম একটা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা জায়গা থেকে ভরসা কী করে তাঁর ও তাঁর মতো দেশজ দেহাতি মানুষদের ভরসাস্থল হয়ে উঠল আর মান, হুঁশ ও মনুষ্যত্বের স্থাপনা রেখে গেল, এ-নাটকে তা-ই চিত্রিত হয়েছে। প্রসবমুহূর্তে স্ত্রী ও সন্তানের মৃত্যু, ব্যর্থ দাম্পত্য ও বাৎসল্য ভরসাকে হনন, স্বহনন বা নির্লিপ্তির পথে নিয়ে গেল না। বাধ্যতার ব্যাধবৃত্তি থেকে সরে বরং তারপরই সে মানবকল্যাণের উজ্জ্বল উদ্ধার রেখে গেল। অন্যের অন্তঃসত্ত্বা আওরাতকে কাঁধে চাপিয়ে শহরে হাসপাতালের পথে নিয়ে যেতে সে যখন হাতের বর্শাটাকে চালনা করে আর রতনদের দলটাকে পাশে-পাশে চালিয়ে নিয়ে যায়, মেঘ ফুটিয়ে সে সূর্য আনতে চলেছে। তার যাওয়া নয়, যাত্রা; চাওয়া নয়, দাবি।

দশরথ মাঝির কথা আমাদের মনে পড়তে পারে। জন্মের পর শিশুর কপালে সে যখন চুম্বনের উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়, তাকে কেমন জাতির নায়কের মতো লাগে। ব্যথায় নেতিয়ে পড়া এবং সর্বান্তকরণে অসহায় একটি মেয়ে যে ধর্ষণের উপজীব্য হল না, তাকে যে পাশ কাটিয়ে ও দায়কে শিকনির মতো ঝেড়ে ফেলে চলে যাওয়া গেল না, এগুলোই মনে করিয়ে দেয় ওখানে সমান্তরাল পৃথিবী চলছে। তা তথাকথিত আধুনিক, আত্মসর্বস্ব ও পণ্যজীবী নয় বলেই 'হতে পারত' পৃথিবী বা 'হল না' পৃথিবীর জিওগ্রাফিক্যাল মডেলস্বরূপ। অন্যত্র হলে প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি বা অরুণা শানবাগের পরিণতি তার হতেই পারত। হাসপাতাল চত্বরে একটি আসতে চলা শিশু ও আর্ত মায়ের জন্য, রাষ্ট্র যাকে মানুষ বলে না এহেন একটা জনপদের যে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা আমরা দেখেছি, তার ছত্রধর হল ভরসা। তার মধ্যে ঈশপের গল্পের একটা বুড়ো লুকিয়ে আছে, যে জেনেছিল আদর্শায়িত পৃথিবীর জন্য সেই গুপিমন্ত্রখানি: united we stand, divided we fall. রাষ্ট্র, শহর, অ্যাকাডেমিকস, ব্র্যাকন্ড ভ্যালু যা শেখাতে গিয়ে পারে না; খাটো ধুতি আর খালি গায়ের ভরসা ও ভরসারা তার পাওয়া ও পালন করা লোকায়ত শিক্ষায় অতি সহজে তা পেনিট্রেট করে দেয়।…

ভরসার চরিত্রে সপ্তর্ষিদা(মৌলিক) মঞ্চ ও মঞ্চের বাইরের দর্শকাসন সংলগ্ন জায়গাটি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তাতে ভরসার কাঁধ প্রসারিত হয়ে উপস্থিত দর্শককে সম্মোহনবৃত্তে টান দেয়। পেশা, পোশাক, ভাষা, উপার্জন কিছু সময়ের জন্য বিস্মরণ হলে আমাদের 'মানুষ' হয়ে উঠতে সমস্যা থাকে না। সন্তানের জন্মকালীন সময়ে আনন্দমুহূর্ত থেকে সন্তানের জন্মপর মৃত্যু ও ধাই মা-র প্রতি প্রাথমিক অবিশ্বাস ফুটিয়ে তোলার যে শরীরী প্রকাশন তিনি করেছেন, তা দীর্ঘদিন অভিনয়-নৈপুণ্যের উদাহরণ হবে। অন্তঃসত্ত্বা নারীর চরিত্রে অনিন্দিতাদি পাহাড় ভাঙার দৃশ্যে দড়ি বেয়ে ওঠা, হাত ফসকে যাওয়া ও পুনর্বার ওঠার দৃশ্যে দৃষ্টান্ত রেখেছেন। রতনের চরিত্রে অর্ঘ্যদা (দে সরকার) জানেন অভিনয় অভিনয় নয়। প্রেম ও শ্রম, আগুন ও জলের কোন সুমিশ্রণে ব্যক্তি চরিত্র হয়ে ওঠে, তার নমুনা তাঁর অভিনয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে। ধাই মা-র চরিত্র ঐন্দ্রিলাদি অনন্যসাধারণ। ভরসাকে সন্তানের মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক খবরটি পৌঁছে দিতে গিয়ে তাঁর কান্না আমাদেরও সমান তোলপাড় করতে থাকে। তাঁর অভিনয়ের সার্থকতা এখানেই। ভাষ্যকার অয়নদা-র বাংলা উচ্চারণ বাংলা রেডিও-র আর. জে.-দের শিক্ষণ হবার যোগ্যতা রাখে। প্রসঙ্গত, চরিত্র নির্বিশেষে দেহাতি হিন্দি উচ্চারণের যে সাবলীলতা, তা অবশ্যই মেধা ও চর্চার সমন্বয়। যাঁদের নাম উল্লেখ করতে পারলাম না, তা একান্ত আমার অজ্ঞতার কারণেই। তাঁরা নিজ মহিমায় আমায় মার্জনা করবেন। নাটক টিম গেম। তাকে জয়জিৎ হতে গেলে প্রত্যেককেই প্রত্যেকের মতো হতে হয়। আলোকসম্পাত, দৃশ্যপট নির্মাণও অনুরূপ উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে এই নাটককে। অন্যদিকে, আর-আর নাটকে মিউজিক-নির্মাতার ভূমিকায় থাকলেও শৌভিক ভট্টাচার্য এই নাটকে পাল্লা দিয়ে অভিনয়ও করেছেন।

নাটক - মানুষ
নির্দেশনা - সোহিনী সেনগুপ্ত

More From Author See More