‘কুম্ভীলকবৃত্তি’র অভিযোগ বার বার ছায়া ফেলেছে বিশ্বসাহিত্যে, বাদ যাননি বিখ্যাতরাও

/১১

প্রতিটা সাহিত্যই আসলে কিছু ধ্বনির বিন্যাস ও সমবায়ে তৈরি, তাই সব সাহিত্যই আসলে ইতিহাসের কাল থেকে চুরি করা— এমনটাই মনে করতেন আমেরিকার উত্তর আধুনিক প্রজন্মের সাহিত্যিকরা। এই মতকে প্রতিষ্ঠা করতে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের লেখার অংশ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করতেন নানা জায়গায়, এমনকি বন্ধু সাহিত্যিকদের লেখাও চুরি করে নিতেন নির্দ্বিধায়। তবে সেইসব বিতর্ককে বাদ দিলেও নিখাদ সাহিত্য চুরি নিয়ে বিতর্ক কিছু কম হয়নি। কখনও লেখার বিষয়বস্তু তো কখনও বাক্যগঠন পর্যন্ত চুরির অভিযোগ উঠেছে নানা সময়। এমনকি এই অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছেন হেলেন কেলার থেকে বব ডিলান পর্যন্ত। রইল বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসের এমনই কিছু বহু আলোচিত কুম্ভীলকবৃত্তির কাহিনি।

/১১

মাত্র ১১ বছর বয়সে একটি ছোটোগল্প লিখেছিলেন হেলেন কেলার। গল্পের নাম ‘দ্য ফ্রস্ট কিং’। প্রথমে পারকিন্স স্কুল ফর ব্লাইন্ডের বার্ষিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্পটি। পরে গুডসন গেজেট পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয় গল্পটি। আর এরপরেই বেশ কয়েকজন পাঠক খেয়াল করেন, গল্পটির কাহিনি এবং বর্ণনার সঙ্গে মার্গারেট ক্যানবির ‘ফ্রস্ট ফেয়ারিজ’ গল্পটির অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। যদিও এই বিতর্ক পরে ধামাচাপা পড়ে যায়। শেষ জীবনে হেলেন কেলার নিজেই আবার তাঁর আত্মজীবনীতে প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করেন। সেখানে এমনটাও বলেছিলেন, গল্পের বর্ণনা পড়লেই বোঝা যায় কোনো দৃষ্টিহীন লেখকের পক্ষে এমন বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ছোটোবেলায় সৃষ্টির আনন্দে তিনি পুরোটাই নিজের সৃষ্টি মনে করেছিলেন।

/১১

হেলেন কেলার নিজেই প্লেগিয়ারিজমের সমালোচনা করেছিলেন। তবে বিশ্বসাহিত্যে এই বিষয়টি নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। যেমন ইয়ান ম্যাকএয়ান্সের মামলাটিই ধরা যাক। ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘অ্যাটোনমেন্ট’। পরে এই উপন্যাসের ওপর সিনেমাও তৈরি হয়েছে। লেখার শুরুতেই অবশ্য লুসিলা অ্যান্ড্রিউজের স্মৃতিচারণামূলক রচনা ‘নো টাইম ফর রোম্যান্স’-এর ঋণ স্বীকার করেছিলেন তিনি। অ্যান্ড্রিউজও কোনো মামলা করেননি। কিন্তু ২০০৬ সালে অ্যান্ড্রিউজের মৃত্যুর পর তাঁর আইনজীবী ইয়ানের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ইয়ান অবশ্য স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, তিনি তাঁর উপন্যাসের বাস্তব প্রেক্ষিত হিসাবে অ্যান্ড্রিউজের স্মৃতিচারণার সাহায্য নিয়েছেন। তার কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন। তবে বিতর্ক এতই জোরালো হয়ে ওঠে যে ইংরেজি সাহিত্যের বহু রথী-মহারথী ইয়ানের সমর্থনে কলম ধরতে বাধ্য হয়েছিলেন।

/১১

এমনই এক অদ্ভুত বিতর্ক তৈরি হয়েছিল জিল বায়ালোস্কির সমালোচনা গ্রন্থ ‘পোয়েট্রি উইল সেভ ইওর লাইফ’ বইটিকে ঘিরে। এখানে যে কবিদের কথা তিনি বলেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের সংক্ষিপ্ত জীবনীগুলি উইকিপেডিয়া থেকে চুরি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। অবশ্য তাঁর বইয়ের বিষয়বস্তু ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। ফলে এই মামলা মূল বইটির গুরুত্বকে লঘু করছে বলেই মনে করেছিলেন অনেকে। এই মামলাও পরে ধামাচাপা পড়ে যায়। যদিও একটি বই লেখার সময় বায়ালোস্কি আরেকটু যত্নবান হতে পারতেন বলেই মনে করেছিলেন অনেকে।

/১১

প্লেগিয়ারিজমের কথাই যখন হচ্ছে, তখন ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’-এর কথা আসবে না, তা কি হয়? পৃথিবীবিখ্যাত এই বইটিকে ৩ বার প্লেগিয়ারিজমের মামলায় জড়াতে হয়েছে। প্রথমে লুই পেরডু নামের এক লেখক বলেছিলেন তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু চুরি করা হয়েছে। এরপর মাইকেল বাইগ্যান্ট এবং রিচার্ড লেইগ নামের দুই প্রত্নতাত্ত্বিক বলেছিলেন তাঁদের গবেষণা চুরি করা হয়েছে। সম্প্রতি জ্যাক ডুন নামে এক ব্যক্তি আরও দুবার মামলা করেছেন ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’-এর লেখক ড্যান ব্রাউনের বিরুদ্ধে। তবে প্রতিটা মামলাতেই জয়ী হয়েছেন ব্রাউন।

/১১

তবে খাঁটি রচনাচুরির ঘটনাও কিছু কম ঘটেনি। সাউথ কোরিয়ার লেখক সিন-কিউংসুক তার অন্যতম উদাহরণ। ম্যান-এশিয়ান পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক কিউংসুক। তবে ২০১৫ সালে তাঁর বিরুদ্ধেই ওঠে প্লেগিয়ারিজমের মামলা। জাপানি ঔপন্যাসিক ইউকিও মিশিমার একটি উপন্যাস তিনি কার্যত অনুবাদ করে নিজের নামে প্রকাশ করেছিলেন বলে জানান সমালোচকরা। প্রথমে কিউংসুক জানিয়েছিলেন, তিনি আদৌ সেই উপন্যাসটি পড়েননি। অবশ্য পরে সমালোচনার মুখে পড়ে ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হন তিনি।

/১১

তেমনই এক সমালোচিত লেখক আমেরিকার জ্যাকোব এপস্টাইন। ১৯৮০ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ওয়াইল্ড ওট’-এর একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয় ‘দ্য অবজারভার’ পত্রিকায়। সমালোচনাটি লিখেছিলেন মার্টিন অ্যামিস। আর সেখানে তিনি দাবি করেন, তাঁরই লেখা থেকে অন্তত ৫০টি অংশ চুরি করেছেন এপস্টাইন। এরপর এপস্টাইন ক্ষমা চাইলেও তাঁর সেই উপন্যাস বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হন। এমনকি প্রকাশকের সঙ্গে দ্বিতীয় উপন্যাসের চুক্তিও বাতিল করতে হয় তাঁকে।

/১১

তবে শুধুই সমালোচনা নয়, লেখা চুরির জন্য পুরস্কারও পাওয়া যায়। হ্যাঁ, তেমনই এক উদাহরণ তৈরি করেছিলেন জোনা লেহরার নামে এক প্রবন্ধকার। ২০১৩ সালে একটি বক্তৃতার জন্য ২০ হাজার ডলার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। আর এই বক্তৃতার শিরোনাম ছিল, ‘মাই অ্যাপোলজি’ বা আমার ক্ষমাপ্রার্থনা। হ্যাঁ, একের পর এক রচনাচুরির অভিযোগে বিদ্ধ লেহরার ক্ষমা চাওয়ার জন্যই পেয়েছিলেন ২০ হাজার ডলারের পুরস্কার। অবশ্য এর আগে ‘নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকার মোটা মাইনের চাকরি খোয়াতে হয়েছিল তাঁকে।

/১১

রচনাচুরির এমন বিস্তর অভিযোগ ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্ব সাহিত্যে। ২০১৭ সালে লেখিকা এমা ক্লাইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন তাঁর এক প্রাক্তন প্রেমিক। তবে সেই অভিযোগ ছিল আরও বিচিত্র। অভিযোগটি রচনাচুরি সংক্রান্ত নয়। বরং তাঁর ওপর বে-আইনি নজরদারি চালানোর বিরুদ্ধে। এমা ক্লাইন যে তাঁর ওপর নজরদারি চালাচ্ছিলেন, সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ক্লাইনের লেখা ‘দ্য গার্ল’ উপন্যাস পড়েই। কারণ সেই উপন্যাসে নাকি তাঁর লেখা নানা মেইলের বয়ান ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য নজরদারির অভিযোগ স্বীকার করে নিলেও মেইলের বয়ান চুরির অভিযোগ স্বীকার করেননি ক্লাইন।

১০/১১

এমনকি প্লেগিয়ারিজমের অভিযোগ থেকে বাদ যাননি খোদ বব ডিলানও। ২০১৬ সালে তাঁর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে নানা বিতর্ক উঠেছিল সারা বিশ্বে। আর এই বিতর্ককেই উস্কে দিয়েছিল ডিলানের নোবেল স্মারক বক্তৃতাটি। কারণ বক্তৃতার শুরুতে তিনি মবি ডিক-এর স্পার্ক নোটস থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছিলেন। অথচ তাঁর নাম উল্লেখ করেননি। যদিও মৌখিক বক্তৃতায় প্লেগিয়ারিজম সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। আর ডিলানের সমর্থকরাও পালটা বলেছিলেন, মবি-ডিকের রচনাগুলি এতটাই বিখ্যাত যে নাম উল্লেখের প্রয়োজন থাকে না। তবু এই নিয়ে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি তাঁকে।

১১/১১

তবে কুইন্টন রাওয়ানের কাছে এই সমস্ত লেখকরাই নেহাত চুনোপুঁটি। একটি বাক্য, একটি অনুচ্ছেদ বা কিছু বিষয়বস্তু নয় – আস্ত বই চুরির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। আর অভিযোগও একটি দুটি নয়। বলা হয়, রাওয়ানের একটি বইও নাকি তাঁর নিজের লেখা নয়। জন গার্ডনার, জিওফ্রে ও’ব্রায়েন, চার্লস ম্যাককুরির মতো কিংবদন্তি লেখকদের আস্ত আস্ত বই নিজের নামে প্রকাশ করে দিয়েছেন তিনি। এমনকি এই কথা লুকানোর চেষ্টাও করেননি তিনি। প্রতিটা অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েও নির্বিকার থেকেছেন তিনি। সাহিত্যের জগতে এমন কুম্ভীলক হয়তো আর পাওয়া যাবে না।

Powered by Froala Editor

More From Author See More