নিজেই নিজের মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন, এমনই কিংবদন্তি কাহিনি সার্জেন গ্রিনের

যে রোগী নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে, তার জন্য একটি দুটি করে সেকেন্ড গোনা ছাড়া আর করার কিছুই থাকে না। ডাক্তাররাও তখন নিরুপায় হয়ে যান। কিন্তু, যেখানে চিকিৎসক এবং রোগী একই ব্যক্তি, সেখানে কেমন হয় দৃশ্যটা? চিকিৎসক কি তখন নিজের নিঃশ্বাসের মধ্যে মৃত্যুর পদক্ষেপ শুনতে পান? এমনই একটা মুহূর্ত ছিল সেদিন। দিনটা ১৮৬৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর। লন্ডনে হ্যাডলে অঞ্চলের একটি বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন শল্য চিকিৎসক জোসেফ হেনরি গ্রিন। আর রয়েছেন কয়েকজন চাকর-বাকর। এর মধ্যেই প্রত্যেককে ডেকে শেষ কয়েকটা কথা বলে ফেলেছেন সার্জেন গ্রিন। অপেক্ষা শুধু অন্তিম সময়ের। আর সেই অপেক্ষায় নিজের নাড়ি ধরে বসে আছেন তিনি। সামনে তাঁর স্ত্রী এলিজা। এমন সময় একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলেন সার্জেন। ‘স্টপড’। বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শিরায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ মৃত্যু। এভাবেই নিজের মৃত্যুর কথা নিজেই ঘোষণা করে গিয়েছিলেন সার্জেন জোসেফ হেনরি গ্রিন।

আজকাল নিজের নাড়ি ধরে স্পন্দন অনুভব করেন সবাই। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই সামান্য কাজটাও রীতিমতো প্রশিক্ষিত মানুষরা ছাড়া কেউ করতেন পারতেন না। তাই সার্জেন গ্রিনের মৃত্যুর ঘটনা শুনতে যতটা সহজ মনে হয়, আদতে ততটাও নয়। এখানে একটু ভুল মানেই ঘটে যেতে পারত দুর্ঘটনা। অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তারের হাতেও মৃত্যুর সঠিক শংসা মিলত না অনেক সময়। ফলে জীবিত মানুষদের কফিনবন্দি করে কবরে শায়িত করার ঘটনাও তখন ইউরোপে নতুন নয়। অনেক জায়গাতেই দেখা যেত কফিনের ভিতরের মৃতদেহের হাত-পায়ের সঙ্গে দড়ি বেঁধে তার অপর প্রান্ত বেঁধে রাখা হত ঘণ্টার সঙ্গে। আসলে মৃতদেহ যাতে হঠাৎ বেঁচে উঠলে টের পাওয়া যায়, তাই এই ব্যবস্থা।

অতএব বোঝাই যাচ্ছে, একটি মৃত্যু ঘোষণা করা কতটা কঠিন একটি কাজ। আর সেই কাজটা একজন মৃত্যুপথযাত্রীর হাতে ছেড়ে দেওয়াও কি সহজ কথা? কিন্তু এক্ষেত্রে মানুষটি যে সার্জেন জোসেফ হেনরি গ্রিন। ইংল্যান্ডের শল্য চিকিৎসার জগতে তিনি যে একজন প্রবাদ-পুরুষ। তাই তাঁর জীবনে এমন একটা ঘটনা খুব আশ্চর্য করে না।

১৭৯১ সালে এক বণিক পরিবারে জন্ম জোসেফ হেনরির। ছোটো থেকেই ব্যবসায়ী পরিবেশে বড়ো হলেও তাঁর নিজের আগ্রহ ছিল সব সময় নতুন নতুন জ্ঞান আহরণের দিকে। আর সেই অজানার সঙ্গে যদি মানুষের দেহ জড়িয়ে থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। আর নিজের এই অদম্য আগ্রহের প্রশ্রয় পেতেন মামা হেনরি ক্লাইনের কাছ থেকে। ‘মামাবাড়ির আবদার’ কথাটা যেন আক্ষরিক অর্থেই সত্যি হয়ে উঠেছিল গ্রিনের জীবনে। লন্ডনের প্রথাগত অ্যানাটমি চর্চার একেবারে প্রথম দিকের কিংবদন্তিদের একজন হেনরি ক্লাইন। আর তাঁর প্রশ্রয় পেয়েই শেষ পর্যন্ত ইকিৎসার জগতে পা রাখলেন জোসেফ গ্রিন।

আরও পড়ুন
নবম শতকের চিকিৎসাবিজ্ঞান, ‘মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া’ ও এক মুসলিম চিকিৎসক-গবেষকের গল্প

সেন্ট থমাস হাসপাতালে সার্জারি বিভাগে ভর্তি হলেন জোসেফ গ্রিন। প্রথম থেকেই যেন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে ছাত্রাবস্থাতেই এলিজা হ্যামন্ডের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন জোসেফ। এর দুবছরের মাথাতেই তিনি পাশ করা চিকিৎসক হয়ে ওঠেন। তবে শুধু সেখানেই শেষ নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাশাপাশি তখন শুরু করলেন দর্শনের চর্চা। আর দুই বিষয়েই তিনি হয়ে উঠলেন লন্ডনের বিশেষজ্ঞদের একজন। সেন্ট থমাস কলেজের পড়ুয়াদের কাছে যেমন তাঁর মতো শিক্ষক হয় না, তেমনই রোগীদের কাছেও তিনি ভগবান। একাধিকবার রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন। বহু গবেষণাও তত্ত্বাবধান করেছেন।

সেই মানুষটি রোগশয্যায় শুয়ে কোনো অভিযোগের কথা বলেননি। বলেননি কোনো অহঙ্কারের কথাও। পরিচারকদের তিরস্কার করেননি তিনি। শুধু সকলকে ডেকে বলেছিলেন -- আমাকে সুস্থভাবে বাঁচতে সাহায্য করার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। শেষ মুহূর্তেও জীবনের কাছে এমন সপ্রতিভ হয়ে আর কজনই বা থাকতে পারেন? তিনি ব্যতিক্রম, তাই তো তিনি জোসেফ হেনরি গ্রিন।

আরও পড়ুন
ইহুদি-নিধন তরান্বিত করছিল মহামারী, থামালেন নাৎসি ক্যাম্পে বন্দি চিকিৎসকরাই

Powered by Froala Editor

More From Author See More