দেশভাগ থেকে এনআরসি – ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে

খাতা পেরোলাম, ইমিগ্রেশন খাতা
লঞ্চ পেরোলাম, তারপর ট্রেন পথ
কোন এক দেশে আমরা যাচ্ছিলাম
যত গেছি তত ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে পথ
(জয় গোস্বামী)

র‍্যাডক্লিফ সাহেব দেশভাগ করার দায়িত্বভার পাওয়ার আগে কোনোদিন ভারতবর্ষে পা রাখেননি। এই দেশ কেমন, কারা থাকেন, কী পরেন, কী খান-- সে সম্বন্ধে লন্ডনের কাগজে কিছু লেখা-পড়া ছাড়া আর কোনও অভিজ্ঞতাই যাঁর ছিল না, সেই র‍্যাডক্লিফই ভারতে এসে দু’মাসের মধ্যে ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্রের উপর দিয়ে দুটো লম্বা দাগ টেনে তৈরি করলেন দুটি নতুন দেশ – ভারত এবং পাকিস্তান। দেশ স্বাধীন হল, জন্ম নিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মিডনাইটস চিলড্রেন। যখন দেশ স্বাধীন হচ্ছে, তখন কলকাতা দুয়োরানি, সব আলো দিল্লির দরবারে। শুধু একটি মানুষ কলকাতার বেলেঘাটার একটি বাড়িতে বসে অনশন করছেন। অনশন না উপবাস? যিনি একদা বলেছিলেন, দেশ ভাগ হবে তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়েই, সেই তিনিই, মহাত্মা গান্ধী, রণক্লান্ত, পরাজিত হয়ে বসে আছেন হায়দারি মঞ্জিলে। তাঁর সঙ্গীরা প্রার্থনা সঙ্গীত গাইছেন- “ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম/ সবকো সন্মতি দে ভগবান।”

শুধু গান্ধী একা নন, করাচি আর দিল্লিতে যখন আলোর রোশনাই, তখন পাঞ্জাবে সদ্য তৈরি হওয়া সীমান্ত পেরোচ্ছে লাশভর্তি ট্রেন। এপার থেকে। ওপার থেকে। বাংলায় বরিশালের পরিবার এক রাত্রে উঠে আসছে শিয়ালদায়। নোয়াখালিতে আজন্ম বড় হওয়া, সেখানকার গাছে, ঘাসে লেগে থাকা একরত্তি মেয়ে, তার মা, তার ভাইয়ের পরিচয় এক নিমেষে হয়ে পড়ছে উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তু? কে উদবাস্তু নয়? পার্ক সার্কাসে মাঠে যে ছেলেটা আব্বার সঙ্গে হাত ধরে খেলা দেখতে যেত, সে হয়ে গেল ঢাকাইয়া। সে জানেও না যে আর মাত্র পঁচিশ বছর পর তার ঠাঁই হবে মহাম্মদপুর জেনিভা ক্যাম্পে। সে হয়ে যাবে একজন দেশহীন মানুষ। যে মানুষটা জেদ করে রয়ে গেলেন পাবনায় কিংবা রাজশাহীতে, তিনি ঘুণাক্ষরে জানতে পারলেন না তাকেও পঁচিশটা বছরের মধ্যে সব খুইয়ে আশ্রয় নিতে হবে যশোর রোডের ধারে উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। যশোর রোড কত কথা বলে…

মোদের কোনও দ্যাশ নাই, মোদের কোনও ভাষা নাই…

১৫ আগস্ট আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা যেমন নিশ্চিত করেছে, তেমনি স্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছে এই উপমহাদেশের বুকে – দেশভাগের ক্ষত, যে ক্ষত, যে যন্ত্রণা আজও আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বৃহত্তম এক্সোডাসের সাক্ষী এই উপমহাদেশ। দু’কোটির বেশি মানুষ নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে এক নিমেষে দেশান্তরী হয়েছিলেন। হয়েছেন। হচ্ছেন। যে দ্বিজাতি তত্ত্বকে সামনে রেখে এই দেশভাগ হয়েছিল, সে তো কবেই মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশের জন্মের মুহূর্তে। কিন্তু দেশভাগের অভিশাপ কাটে কই! আজও এই উপমহাদেশে রোজ মানুষ উদ্বাস্তু হন, কাঁটাতার পেরিয়ে চলে যান অন্যপারে। কিন্তু সেখানেও সেই একই শোষণ, অবিচার, অত্যাচার। যে বিহারি মুসলমান দেশ ভেবে পৌঁছেছিলেন ঢাকায়, তিনিই আজ নিজভূমে পরবাসী। আজ যে বাঙালি হিন্দু দেশ খুঁজতে সিলেট থেকে গেছিলেন শিলচরে, তিনিই আজ বেনাগরিক। মোদের কোনও দ্যাশ নাই, মোদের কোনও ভাষা নাই…

যে মানুষগুলো র‍্যাডক্লিফের কলমের খোঁচায় দেশান্তরি হলেন আজ তাদেরকেই নতুন করে প্রমাণ দিতে হচ্ছে তাদের নাগরিকত্বের। যে মুসলমান চাষিকে ময়মনসিংহ থেকে ইংরেজরা ইজারা দিয়ে নিয়ে এল ব্রহ্মপুত্র নদের চরে, তাকেই আজ মিয়াঁ বলে ডিটেনশেন ক্যাম্পে পুরছে দেশের সরকার। দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোজ আঙুল তুলে শাসাচ্ছেন – “ঘুষপেটিয়াদের সব বের করে দেব!” দেশে নতুন মড়ক লেগেছে – মড়কের নাম এনআরসি। এই মড়কে ধরলে একটা গোটা মানুষ হঠাৎ একদিন দেশহীন হয়ে যান। আজ দেশের একচল্লিশ লক্ষ মানুষ জানেন না একত্রিশ আগস্টের পর তাঁদের সঙ্গে কী হবে, তারা কোথায় যাবেন – কারণ এই ভারতবর্ষ যে একদিন তাঁকে সাদরে বুকে টেনে নিয়েছিল, সেই ভারতের সরকার, আদালত তাঁকে দেশহীন বলে ঘোষণা দিয়েছে।

কী দোষ বলুন তো সেই মানুষটার, যে দাঙ্গায় সব খুইয়ে কুপার্সে এসে আশ্রয় পেল? কী দোষ বলুন তো সেই মানুষটার, যে বাঙালি হওয়ার অপরাধে খানসেনার তাড়া খেয়ে বনগাঁয় এসে উঠল? কী দোষ সেই মানুষটার যে পেটের টানে আসামে গেল? কেউ ভিটে ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে শখ করে দেশান্তরী হয়নি।

স্বাধীন ভারতে আমাদের অনেক না পাওয়া আছে, ক্ষোভ আছে, বঞ্চনা আছে। কিন্তু তারপরেও সুখ না থাকলেও শান্তি ছিল যে দেশটা বলকান অঞ্চল হয়ে যায়নি, এতগুলো ভাষা, এতগুলো ধর্ম একসঙ্গে থাকা সত্ত্বেও। এই না পাওয়াগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই ছিল – রাজ্যে যখন খাদ্য আন্দোলন শুরু হয়, তার প্রথম পথ চলা শুরু সেই রিফিউজি কলোনি থেকেই। কিন্ত এই আশ্বাস ছিল, এই বিশ্বাস ছিল যে এই ভূখণ্ড আমার, দেশান্তরী হয়ে যে ভূমিতে এসে আশ্রয় পেয়েছি, সে ভূমিই আমার দেশ, সেই ভূমির সব বাসিন্দাই আমার সহনাগরিক। আজ এনআরসি-র দানবীয় প্রক্রিয়া এই বিশ্বাস টলিয়ে দিয়েছে। আসামের গ্রামে গ্রামে মানুষ শুধু কাগজ আর নথি খুঁজে চলেছেন, আর কদিন পরে রুখতে যদি না পারি তবে বাংলাতেও তাই। আজ এককুচি কাগজের দাম আস্ত একটা মানুষের থেকে অনেক বেশি।

কী দোষ বলুন তো সেই মানুষটার, যে দাঙ্গায় সব খুইয়ে কুপার্সে এসে আশ্রয় পেল? কী দোষ বলুন তো সেই মানুষটার, যে বাঙালি হওয়ার অপরাধে খানসেনার তাড়া খেয়ে বনগাঁয় এসে উঠল? কী দোষ সেই মানুষটার যে পেটের টানে আসামে গেল? কেউ ভিটে ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে শখ করে দেশান্তরী হয়নি। মানুষকে দেশান্তরী করে মুষ্টিমেয়’র ধর্মান্ধতা, ক্ষমতালিপ্সা। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু আজ ১৪-১৫ই আগস্টের দেশভাগের শিকার। র‍্যাডক্লিফের শিকার। যারা দেশ ভাঙতে চেয়েছিল তাদের শিকার। আর তাই সব আন্তর্জাতিক আইনকে, চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে এনআরসি হয়ে চলেছে, হতে চলেছে, তা শুধু অনৈতিকই নয়, অমানবিকও বটে।

আজ বাহাত্তর বছরে পা দিল স্বাধীনতা। কিন্তু, যদি আজও আমাদের দেশভাগের সেই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়, যদি ‘রামরাজত্বে’ আজও আমাদের সেই সীতার মতো প্রতি মুহূর্তে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ দিয়ে যেতে হয় নিজেদের নাগরিকত্বের, দেশপ্রেমের তবে তার চেয়ে লজ্জার আর ঘৃণার কিছু আছে কী? এই দেশ মানুষের, র‍্যাডক্লিফের কলমের দাগের কাছে সে কখনই হেরে যেতে পারে না।

ছবি: পাঞ্জাবের দেশভাগ
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত