এনআরসি হলে বিপদে পড়বেন 'হিন্দু' বাঙালিরাও

আগামীকাল অসমের এনআরসি’র চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হতে চলেছে। অর্থাৎ, এই তালিকা থেকে যাঁরা বাদ পড়বেন, তাঁদের আর ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বলে গণ্য করা হবে না। ২০১৫ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এবং তত্ত্বাবধানে যে কাজ শুরু হয়েছিল, তার ইতি পড়তে চলেছে আগামীকাল লক্ষ লক্ষ মানুষকে নাগরিকত্বহীন করে দিয়ে। ২০১৮ সালের ৩১শে জুলাই যে প্রাথমিক চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে বাদ পড়েছিলেন প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ। এনআরসি’র নিয়ম অনুসারে কারোর নাম একবার তালিকাভুক্ত হলেই তিনি নিশ্চিত নন, কারণ তারপরেও তাঁর বিরুদ্ধে যে কেউ, এমনকি তাঁর প্রতিবেশীও চাইলে গিয়ে এনআরসি আপিসে প্রমাণ সহকারে অভিযোগ জানিয়ে আসতে পারেন যে ওই ব্যক্তি আসলে বিদেশি। তখন তাঁকে আবার প্রমাণ করতে হয় নাগরিকত্ব। এইভাবে আরও ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের নাম এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়েছে গত এক বছরে এবং সর্বমোট বাদ পড়ার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪১ লক্ষেরও বেশি।

কারা বাদ পড়লেন?

এনআরসি’র উৎপত্তির কথা মাথায় রাখলেই কারা বাদ পড়লেন সেটা স্পষ্ট করে বোঝা যায়। ১৯৭০-৮০ দশকের অসম আন্দোলন ওরফে বঙ্গাল-খেদা আন্দোলনের ফলে যে ত্রিপাক্ষিক ‘অসম চুক্তি’ সাক্ষরিত হয়েছিল আন্দোলনকারী, ভারত সরকার, অসম সরকারের মধ্যে তাতেই এনআরসি’র বীজ বপন করা ছিল। ওই চুক্তিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চের পর যারা অসম প্রদেশে এসেছেন তাদেরকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। সুপ্রিম কোর্ট এনআরসি’র রায় দিতে গিয়ে এই তারিখকেই মান্যতা দিয়েছে। এই তারিখের তাৎপর্য কি? ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনা ‘অপারেশান সার্চলাইট’ শুরু করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, যার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় গত শতাব্দীর অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা, ন’মাসে প্রাণ হারান ৩০ লক্ষ মানুষ, ধর্ষিতা হন অগুনতি মহিলা। আর উদ্বাস্তু হন এক কোটি মানুষ। এঁরা আশ্রয় নেন কেউ পশ্চিমবাংলায়, কেউ অসমে, কেউ ত্রিপুরায়। অর্থাৎ, প্রথমেই এই উদ্বাস্তুদের বাদ দিয়ে দেওয়া হল তালিকা থেকে। এঁদের মধ্যে সবর্ণ হিন্দু, নমঃশুদ্র, মুসলমান, সব জাত-ধর্মের মানুষ রয়েছেন। কিন্তু এদের সকলের ভাষা এক – এঁরা বাংলাভাষী। এছাড়া ১৯৭১-এর আগে থেকে অসমে থাকেন, এরকম বহু মানুষ তালিকাভুক্ত হননি। তার প্রধানতম কারণ হচ্ছে তাঁরা গরিব, অসহায়। এনআরসি প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল এবং এক কথায় বললে স্বাভাবিক বিচারের পরিপন্থী। যেখানে এনআরসি হয়, সেখানে প্রথমেই ধরে নেওয়া হয় যে সেখানকার সমস্ত বাসিন্দা অ-নাগরিক। এরপর তাঁদের প্রমাণ করতে হয় যে কাট-অফ ডেটের (অসমের ক্ষেত্রে ২৪শে মার্চ, ১৯৭১) আগে তিনি বা তাঁর পূর্বপুরুষরা এই দেশে বসবাস করতেন। এখন স্বাভাবিকভাবেই একটা বিশাল বড় অংশের মানুষের কাছে এই প্রামাণ্য নথিপত্র নেই যা দিয়ে প্রমাণ করা যাবে যে তিনি বা তাঁর বাবা-মা অসমে থাকতেন আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছেই এই নথি নেই, গরিব ভারতবর্ষ, গ্রামীণ ভারতবর্ষে সেটাই স্বাভাবিক। আর তার ফলে বাদ পড়েছেন অনেক অনেক মানুষ, এঁদের মধ্যে শুধু বাঙালি নয়, অসমীয়া, গোর্খা, বিহারি, আদিবাসী সবধরণের মানুষেরাই আছেন।

এঁদের ভবিষ্যত কী?

আগামীকাল যে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশহীন হতে চলেছেন, তাঁদের ভবিষ্যত কী, এই নিয়ে ভারত সরকার, অসম সরকার, সুপ্রিম কোর্ট, তার প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগোই (যিনি অদ্ভুতভাবে একইসঙ্গে একজন এনআরসি এপ্লিকান্ট এবং এই মামলার বিচারপতি) কেউই মুখ খুলছেন না। ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে যে যারা বাদ পড়ছেন, তাঁরা এখনই বিদেশি বলে গণ্য হবেন না। তাঁদের মামলাগুলি ফরেনার্স ট্রাইবুনালে যাবে, এবং সেখান থেকে তাঁরা বিদেশি বা বিদেশি নন সেটি ঠিক হবে। অর্থাৎ, কাল যদি তর্কের খাতিরেও ধরে নিই শেষ অবধি ১০ লক্ষ মানুষ বাদ পড়বেন, তাহলেও তাঁদের এই মামলাগুলির নিষ্পত্তি হতে কম করে ৫ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যাবে। যারা বিদেশি প্রমাণিত হবেন, তাঁদের সরকার ডিটেনশান ক্যাম্পে ভরবে এক এক করে। ফলে একসঙ্গে ১০ লক্ষ মানুষকে ডিটেনশান ক্যাম্পে পাঠালে তার বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া হবে আর মাসে ১০ জন করে পাঠালে যে প্রতিক্রিয়া হবে তার মাত্রাগত ফারাক অনেক।

কেন্দ্রীয় সরকার গত লোকসভাতে একটি বিল পেশ করে – নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। এই বিল অনুযায়ী বলা হচ্ছে, আমাদের প্রতিবেশী তিনটি দেশ – পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, শিখ, পারসিক ধর্মালম্বী যেসমস্ত মানুষ আসবেন তাদেরকে সরকার ছয় বছরের স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নাগরিকত্ব প্রদান করবে। এই বিলকে সামনে রেখে বিজেপি প্রচার চালাচ্ছে যে, তারা এনআরসিতে বাদ পড়া হিন্দুদেরকে নাগরিকত্ব ফেরত দেবে, আর মুসলমানদের ঠাই হবে ডিটেনশান ক্যাম্পে। এই বিল সম্পূর্ণভাবে দেশের সংবিধান বিরোধী। আমাদের দেশের সংবিধানে কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। কাজেই এই বিল পাশ করালেও সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা একশো শতাংশ। ফলে এর মাধ্যমে যাঁরা ভাবছেন এনআরসিতে বাদ পড়া হিন্দুদের কিছু হবে না, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। আর আজ সেকথা বুঝেই অসমের বিজেপিও এনআরসির বিরুদ্ধে সরব, অথচ তাদের হাতেই কেন্দ্রীয়, রাজ্য সরকার, তাদের নেতারাই রোজ বলছেন এনআরসি করে ‘ঘুষ্পেটিয়াদের’ তাড়ানো হবে, আর অন্যদিকে প্রদেশ বিজেপি হিন্দুদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু পাত করছেন।

বাংলার কী হবে?

অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনের সময়ে দু’বেলা করে বাংলায় এসে এনআরসির জন্য তদ্বির করেছেন। রাজ্যের বিজেপি নেতারা প্রত্যেকদিন এনআরসি’র দাবি তুলছেন, যেন বা সেটাই আমাদের রাজ্যের সব সমস্যার সর্বরোগহারী সমাধান। অন্যদিকে অসমের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি কীভাবে একটা রাজ্য ছারখার হয়ে গেছে এনআরসির আগুনে। বাংলার ক্ষেত্রে, বিষয়টি সম্পূর্ণ অন্য, এটা যারা এনআরসি’র সমর্থক তাদেরকে বুঝতে হবে। দেশভাগের পর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সবথেকে বেশি উদ্বাস্তু যদি কোনো রাজ্যে এসে থাকেন তবে সেটি পশ্চিমবঙ্গ। আমাদের রাজ্যের ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ শতাংশ জনগণ ওপার থেকে আসা উদ্বাস্তু নয়তো তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম। এঁদের মধ্যে সবর্ণ হিন্দুরা আছেন, আছেন বিশাল সংখ্যার নমশূদ্ররা, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অত্যাচারিত হওয়া মুসলমানরাও। এনআরসি এঁদের সকলের স্বার্থের বিরুদ্ধে। ভাবুন, অসমের তিন কোটি মানুষের মধ্যে যদি চল্লিশ লক্ষ মানুষ বাদ পড়েন তবে উদ্বাস্তু অধ্যুষিত বাংলায় তো কোটি কোটি মানুষ বাদ পড়বেন! এঁদের নিয়ে সরকার কী করবে? সবাইকে ডিটেনশান ক্যাম্পে পাঠাবে? গোটা দেশটাকেই কি এরা জেলখানা বানাতে চাইছে?

এরপরেও যে প্রশ্ন থেকে যায় যে এখানে তো অসম আন্দোলনের মত কোনো আন্দোলন হয়নি। এখানে এনআরসি করতে হবে এরকম কোনো দাবিও নেই, তবে এখানকার সাধারণ মানুষের, কোটি কোটি উদ্বাস্তু মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে কেন কেন্দ্রীয় সরকার এনআরসি করতে চাইছে? এবং তারপরে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থাকে তা হল, বাংলার ক্ষেত্রে কাট অফ ডেট কী হবে? অসমে অসম চুক্তি অনুসারে ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ তারিখ ঠিক হয়েছিল, এখানে এরকম কোনো চুক্তি নেই, তবে কি এখানে ১৯৪৭ সাল কাট অফ ডেট হবে? এসবের কোনো উত্তর নেই এনআরসি’র সমর্থকদের কাছে।

আসলে বিষয়টি হচ্ছে ভারতবর্ষের এই যে বহুধর্ম, বহুভাষাভাষীর মানুষ পাশাপাশি থাকেন, মিলেমিশে থাকেন এটা কিছু মানুষের পছন্দ নয়। তাই তাঁরা দেশে যে-কোনো প্রক্রিয়াতে অশান্তি তৈরি করতে চায়। এনআরসি, নাগরিকত্ব বিল এসব সেই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ। ইতিমধ্যে দেশজুড়ে জাতীয় জনপঞ্জী তৈরির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। যা এনআরসি’র প্রথম ধাপ। এর বিরুদ্ধে সোচ্চারে প্রতিবাদ ছাড়া পথ নেই। এনআরসি বাঙালি বিরোধী, বাংলা বিরোধী, দেশবিরোধী, সর্বোপরি মানবতাবিরোধী। তাই একে রুখতেই হবে। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)